তাইওয়ানে বন্ধ হচ্ছে স্কুল, কারণ কী
অর্থনীতিতে এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী দেশ তাইওয়ান। দশকে দশকে অর্থনীতিতে প্রভূত উন্নতি হয়েছে এ দেশের। তবে এর সঙ্গে বাড়ছে দেশটির দুশ্চিন্তাও। কারণ, অর্থনীতির উন্নয়নের মধ্যও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে স্কুল। কেন এমন হচ্ছে, তা দেখে নেওয়া যাক।
রাজধানী তাইপের চুং সিং বেসরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সব ডেস্ক, চেয়ার, বেঞ্চ জড়ো করে রাখা খেলার মাঠে। সেখান থেকে পিকআপে করে সেগুলো সরিয়ে নিচ্ছেন নির্মাণকর্মীরা। শিক্ষার্থী ভর্তির হার এতই কমতে শুরু করেছিল যে ২০১৯ সালে আর্থিক সংকটে স্কুলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিদ্যালয়ের জায়গাটি এক আবাসন কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। এখন স্কুলভবনটি ভেঙে ফেলবে ওই আবাসন কোম্পানি। তাইপের মধ্যাঞ্চলের একটি বেসরকারি স্কুলে এ পরিণতি আসলে পুরো তাইওয়ানের চিত্রেরই প্রতিচ্ছবি। জন্মহার কমার প্রভাব অন্যান্য খাতের মতো শিক্ষা খাতেও পড়ছে। শ্রেণিকক্ষগুলো শিক্ষার্থীপূর্ণ না থাকায় এমন অবস্থা হয়েছে।
পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, উন্নতি না হলে তিনি আশা করছেন আরও ৪০ থেকে ৫০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ২০২৮ সালের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে
এশিয়ার অন্য অনেক দেশের মতো তাইওয়ানেও স্থিতিশীল জনসংখ্যা ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অর্জিত হচ্ছে না লক্ষ্য। গড় মৃত্যুহার যদি গড় প্রজনন হারের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে জনসংখ্যার প্রতিস্থাপন হারে পতন হয়। আর এ দুটি সমান সমান থাকলে স্থিতিশীল থাকে জনসংখ্যা। জনসংখ্যার স্থিতিশীলতার জন্য তাইওয়ানের প্রজনন হার ঠিক রাখতে নারীপ্রতি সন্তান থাকা দরকার গড়ে ২ দশমিক ১। তাইওয়ানের নারীরা যদি এই হারে শিশু জন্ম দেন, তাহলে জনসংখ্যার পতন রোধ করা যাবে। কিন্তু, ১৯৮০–এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে এর ধারেকাছেও যেতে পারছে না তাইওয়ান। ২০২৩ সালে প্রজনন হার নেমে এসেছে শূন্য দশমিক ৮৬–তে।
জন্মহার কমে যাওয়ার ফলে তরুণদের চেয়ে বয়স্ক জনসংখ্যা বেড়ে যায়। এতে অর্থনীতিতে নবীন কর্মীদের ঘাটতি তৈরি হয়। এতে অর্থনৈতিক সংকট নেমে আসতে পারে। বয়স্কদের সংখ্যা বেড়ে গেলে সীমিতসংখ্যক তরুণের করের টাকায় বয়োবৃদ্ধদের দেখভাল করা বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে। এমন আশঙ্কা তাইওয়ানের সরকার ও জনসংখ্যাবিদদের।
তাইওয়ানে জীবনযাপনের মান উন্নত হলেও গত কয়েক দশকে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়েছে। এদিকে জন্মহার কমার ফলে তরুণদের সংখ্যা কমছে। তাইওয়ানের সামরিক বাহিনীতেও এর প্রভাব পড়েছে।
এখন সেই প্রভাব পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলের ভর্তির ক্ষেত্রেও। ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে, তাইওয়ানের প্রাথমিক ও জুনিয়র হাইস্কুলগুলোয় ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৩ লাখ থেকে নেমে এসেছে ১৮ লাখের নিচে।
রাজধানী তাইপে সিটিতে থাকেন মিসেস লাই। তাঁর ২২ মাস বয়সী এক সন্তান রয়েছে। আর সন্তান নিতে চান না তিনি। লাই বলেন, ‘সন্তান লালন–পালনে ব্যয় এখন অনেক বেশি, সেটা অর্থ আর সময় দুদিক থেকেই। বেতন বাড়ানো আর কর্মঘণ্টা কমানো না হলে দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার কথা ভাবাই যায় না। বর্তমান আয় ও সময়ের কথা বিবেচনা করে আমি এখন নিজের ও সন্তানের জীবনযাপনের মানের দিকে মনোনিবেশ করেছি। দ্বিতীয় সন্তান হলে সন্তোষজনক এ অবস্থা বজায় রাখা কঠিন হবে।’
তাইওয়ানের প্রাইভেট স্কুলগুলো সরকারি স্কুলগুলোর মতো জনপ্রিয় নয়। শিক্ষার্থী না থাকায় প্রথমেই বন্ধ হচ্ছে বেসরকারি স্কুলগুলো। দেশটিতে বেসরকারির চেয়ে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানকে পড়াতে আগ্রহ বেশি অভিভাবকদের। ফলে আপাতত সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার্থীসংকট নেই।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিজস্ব আয়ে চলতে হয়, শিক্ষার্থী কমতে থাকলে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর খোলা রাখা যায় না।
দেশটির অন্যতম গণমাধ্যম তাইপেই টাইমসের মার্চ মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে কয়েক ডজন বেসরকারি স্কুল বন্ধের উপক্রম। অর্থসহায়তা দিতে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি তালিকাও করেছে সরকার। বর্তমানে এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে ১৩টি বেসরকারি স্কুল ও কারিগরি উচ্চবিদ্যালয়। এগুলো আগামী বছরের শুরুর দিকেই বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে মার্চের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
তাইওয়ানের শিক্ষা মন্ত্রণালয় গার্ডিয়ানকে জানিয়েছে, ২০১৪ সাল থেকে ১৫টি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়েছে। গত সপ্তাহে তাইওয়ানের ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চারটি বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণ প্রতিবেদনের শুরুতে বলা চুং সিং হাইস্কুলের মতোই।
‘সন্তান লালন–পালনে ব্যয় এখন অনেক বেশি, সেটা অর্থ আর সময় দুদিক থেকেই। বেতন বাড়ানো আর কর্মঘণ্টা কমানো না হলে দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার কথা ভাবাই যায় নালাই, তাইপে সিটির বাসিন্দা
ইউনিয়ন অব প্রাইভেট স্কুল এডুকেটরসের চেয়ারপারসন উ চুন-চুং স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেছেন, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, উন্নতি না হলে তিনি আশা করছেন আরও ৪০ থেকে ৫০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ২০২৮ সালের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে।
তাইওয়ানের হায়ার এডুকেশন ইউনিয়নের সভাপতি চু পিং বলেছেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধের উপক্রম হচ্ছে না। তবে শহরতলির বিশেষ করে যাঁরা স্টেম বিষয়গুলোর চেয়ে মানবিক বিষয়ে পড়ান, তাঁরা সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে।
স্টেম এডুকেশন হলো সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যাথমেটিকস। এই চারটি বিষয়ের আদ্যক্ষর মিলিয়ে সংক্ষেপে বলা হয় স্টেম এডুকেশন।
তাইওয়ানের সরকার (চীন, কোরিয়া ও জাপানের মতো) দম্পতিদের বেশি সন্তান নিতে উত্সাহিত করছে। বিভিন্ন আর্থিক প্রণোদনাসহ নানা সুযোগ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু নারীদের ওপর অন্যায়ভাবে থাকা ঐতিহ্যবাহী লিঙ্গভূমিকার চাপ (কন্যাসন্তান হলে নারী দায়ী), সেই সঙ্গে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান খরচ, ক্যারিয়ারের ভারসাম্য রক্ষাসহ নানা কারণে সরকার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না। তাইওয়ানে বেতন তুলনামূলক কম এবং শহরের বাড়িভাড়া অনেক বেশি। তাইপে হংকংয়ের পর বিশ্বের ব্যয়বহুল শহরের তালিকায় আছে।
বেসরকারির সঙ্গে পাবলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একীভূত করার আহ্বান
উচ্চজন্মহারসহ তাইওয়ানের যেসব অংশে জীবনযাত্রার খরচ কম, সেসব এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে। রাজধানীর কাছাকাছি বা দূরবর্তী দ্বীপগুলো, সিনচু কাউন্টিগুলোর মতো যেখানে ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে, সেখানে পরিস্তিতি ভালো। সিনচু হলো তাইওয়ানের সবচেয়ে ধনী কাউন্টি। এখানে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের বিশাল পার্ক আছে। এসব এলাকার জনসংখ্যা গত পাঁচ বছরে বেড়েছে। এসব এলাকার দিকে তরুণদের আকর্ষণ বাড়ছে।
ঝুবেই এলাকার দুই সন্তানের মা মিসেস হাউ বলেন, ‘আমি মনে করি, ঝুবেই (সিনচু কাউন্টির একটি শহর) অন্য কাউন্টি ও শহরের তুলনায় ভালো। তাই ঝুবেইতে জন্মের হার কমেছে বলে মনে হয় না।’
জিয়াফেং এলিমেন্টারি স্কুলের একাডেমিক অ্যাফেয়ার্সের ডিরেক্টর ফু জি-লিন বলেন, ঝুবেইয়ের অনেক জুনিয়র হাইস্কুল শিক্ষার্থীতে ভরা। অভিভাবকেরা এখানকার স্কুলে শিশুকে ভর্তি করার ব্যাপারে এতটাই উদ্বিগ্ন যে তাঁরা শিশুদের (নবজাতক হলেও) আগে থেকেই নথিভুক্ত (ভর্তির প্রয়োজনীয় আবেদন) করার চেষ্টা করেন। স্থানীয় গণমাধ্যম ধারণ করছে যে ২০২৭ সালের মধ্যে স্কুলগুলোয় ১০০০ নথিভুক্তির আবেদন জমা হবে।
যা–ই হোক, এরপরই সিনচু এলাকার জন্মহার কম বলে মনে করছেন ফু জি-লিন। তিনি বলেন, ‘আগের ২ বছরের তুলনায় গত দুই বছরে শিক্ষার্থী নথিভুক্তির সংখ্যার হার কমেছে। তবে এটিকে খারাপ বলা যাবে না। স্কুলের আকার একই এবং শিক্ষার্থী কম থাকলে, বিদ্যালয়ের পাঠদানের পরিবেশ আরও ভালো হয়ে উঠবে এবং ছাত্রদের জায়গা বেশি হবে।’
হায়ার এডুকেশন ইউনিয়নের সভাপতি চু পিংয়ের অনুভূতি আলাদা। তিনি বলেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ডেভেলপারদের কাছে বিক্রি না করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত করা উচিত। চু পিং বলেন, তাইওয়ান অন্য ওইসিডি দেশের তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কম তহবিল দেয়।
এখানে শিক্ষকদের তুলনায় ছাত্রদের অনুপাতও অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ক্যাম্পাস বাড়াতে পারে। তিনি বলেন, ‘যদি আমরা পাবলিক শিক্ষায় আরও ব্যয় বাড়াতে পারি, তাহলে আমরা আরও কম আয়ের শিক্ষার্থীদের সহায়তা করতে পারব এবং শিক্ষার মান উন্নত হবে।’