প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের পঠনদক্ষতা উন্নয়নে যা করতে হবে
অষ্টম শ্রেণি পাস দপ্তরি করিম এসে বলল, ‘ম্যাডাম এই গাছের নাম জানেন? এটা হলো ইউকালাপটাশ গাছ।’ শুনে আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছিলাম না। যদিও ইউক্যালিপটাস শব্দটি বিদেশি, আমরা কিন্তু একে বাংলা ভাষাতেই পেয়েছি। শোনা কিংবা পড়ার দক্ষতার অভাবে করিমের কাছে ইউক্যালিপটাস হয়ে গেছে ইউকালাপটাশ!
‘পৃথিবীর ইতিহাস আলোচনা করিয়া দেখ মাতৃভাষার উন্নতি ব্যতীত কোনো জাতি কখনো কি বড় হইতে পারিয়াছেন?’—কথাটি বলেছেন ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন।’ বোঝাই যাচ্ছে ইংরেজি কিংবা অন্য ভাষার চেয়ে আমাদের মাতৃভাষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম বাহন মাতৃভাষা। কিন্তু আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিশুদের বাংলায় পঠনদক্ষতা প্রত্যাশিত মানে পৌঁছাতে পারছে কি? বিশ্বব্যাংকের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারে না। ইংরেজি ও গণিতে দুর্বলতা তার চেয়েও বেশি। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা হওয়া সত্ত্বেও কেন আমাদের শিশুরা বাংলা সাবলীলভাবে পড়তে পারে না, এটাই মুখ্য প্রশ্ন।
বাংলা বিষয়ে ভালোভাবে পড়তে না পারলে বাংলায় লিখিত অন্যান্য বিষয়, যেমন প্রাথমিক গণিত, প্রাথমিক বিজ্ঞান, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়েও তারা সাবলীলভাবে পড়তে পারবে না। ফলে প্রতিটি বিষয়েই তাদের ঘাটতি থেকে যাবে এবং ওই সব শিক্ষার্থীর লেখাপড়ায় আগ্রহও থাকবে না।
প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো সব শিশুকে সাবলীল পাঠক হিসেবে গড়ে তোলা। একটি নির্দিষ্ট পাঠ শুদ্ধ উচ্চারণ ও দাঁড়ি-কমা, যতিচিহ্ন ইত্যাদির যথাযথ ব্যবহার করে পড়ে যাওয়ার ব্যবস্থাকে পঠন বলা হয়। মাইকেল বেস্টেরের মতে, ‘পঠন হচ্ছে দৃশ্য ধ্বনি উৎপাদন অর্থোপলব্ধির মিশ্রিত প্রতিক্রিয়া।’ শুধু কোনো পাঠ পড়ে গেলেই হয় না, তার অর্থ উপলব্ধি করতে না পারলে পঠনকার্য সফল হয় না। পঠনের সঙ্গে পাঠকের পর্যবেক্ষণ, চিন্তাধারা এবং অভিজ্ঞতা নিহিত থাকতে হবে। আর সাবলীল পঠন বলতে আমরা বুঝি শিশুর বয়স, সামর্থ্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী তার শ্রেণির বাংলা বই ও শ্রেণি উপযোগী সম্পূরক পঠনসামগ্রী অর্থ বুঝে পড়তে পারা। সাবলীল পঠনের শর্তগুলো হচ্ছে—বর্ণ, শব্দ ও বাক্য সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারা, শুদ্ধ ও স্পষ্ট উচ্চারণ করতে পারা, স্বাভাবিক গতিতে পড়তে পারা, পঠিত বিষয়ের মর্ম বুঝতে পারা, বিরামচিহ্ন ব্যবহার করে, স্বরাঘাত ও স্বরভঙ্গি বজায় রেখে পড়তে পারা। অন্য কথায়, লিখিত কোনো কিছু কারও কোনো রকম সাহায্য ছাড়া অর্থ বুঝে, বিরামচিহ্ন ঠিক রেখে সাবলীলভাবে পড়তে পারার ক্ষমতাকে পঠনদক্ষতা বলা যেতে পারে। মানসম্মত পঠনদক্ষতা হলো প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি বয়সী শিশুদের প্রতি মিনিটে ৪৫ থেকে ৬০টি শব্দ পড়ে তার অর্থ বুঝতে পারা।
কিন্তু বর্তমান চিত্র ভিন্ন। বিশেষ করে করোনাকালে দীর্ঘদিন বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকতে পারেনি। যদিও সরকার নানা পদক্ষেপ নেয় এবং শিক্ষকেরা অনলাইন-অফলাইনে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় যুক্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ঘরে বসে থাকায় তাদের মানসিক স্বাস্থ্যেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়, এর ফলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর পঠনদক্ষতা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়। এই অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণের চেষ্টা করা প্রয়োজন।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়ার দক্ষতা উন্নত করার জন্য তাদের পড়া বোঝা, সাবলীলতা, শব্দভান্ডার এবং সামগ্রিক সাক্ষরতা বাড়াতে কৌশল এবং কার্যকলাপের সমন্বয় জড়িত।
এই বয়সের শিক্ষার্থীদের আরও ভালো পাঠক হতে সাহায্য করার জন্য কিছু কার্যকর উপায় আলোচনা করছি—
একটি পাঠবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা: বিভিন্ন বয়স-উপযোগী বই এবং উপকরণ সরবরাহ করে পড়ার প্রতি ভালোবাসাকে উৎসাহিত করতে হবে।
ধ্বনিসচেতনতা এবং ডিকোডিং দক্ষতা: ধ্বনিসচেতনতা, বর্ণজ্ঞান ও শব্দ শনাক্তকরণ দক্ষতার ওপর ফোকাস করে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করতে হবে। বর্ণ-শব্দ সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে ধ্বনিসচেতনতা ভিত্তিক প্রোগ্রাম বা গেম ব্যবহার করতে হবে।
শব্দভান্ডার বিকাশ: পড়ার মাধ্যমে নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচয় করানো এবং তাদের অর্থ প্রসঙ্গে আলোচনা করা। শিক্ষার্থীদের একটি শব্দভান্ডার জার্নাল রাখতে বা নতুন শব্দ ট্র্যাক এবং অন্বেষণ করতে ডিজিটাল সরঞ্জাম ব্যবহার করতে উৎসাহিত করতে হবে।
জোরে জোরে পড়া: সঠিক উচ্চারণ এবং অভিব্যক্তি প্রকাশ করার জন্য শিক্ষার্থীদের নিয়মিত উচ্চ স্বরে পড়ার অভ্যাস গড়তে হবে। সাবলীলতা তৈরি করতে শিক্ষার্থীদের জোরে জোরে পড়তে বলা উচিত।
বিভিন্ন পঠনসামগ্রী: কল্পকাহিনি, নন-ফিকশন, কবিতা এবং তথ্যমূলক পাঠ্যসহ বিস্তৃত পাঠসামগ্রী সরবরাহ করে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধারা অন্বেষণ করতে উৎসাহিত করা দরকার।
স্বাধীন পড়ার সময়: স্বাধীনভাবে পড়ার জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের তাদের আগ্রহের বই বেছে নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। তাদের অগ্রগতি ট্র্যাক করতে এবং পড়ার লক্ষ্য সেট করতে একটি পড়ার লগ ব্যবহার করা যেতে পারে।
রিডিং পার্টনারশিপ এবং বুক ক্লাব: পঠন অংশীদারত্ব বা বই ক্লাব সংগঠিত করা, যেখানে শিক্ষার্থীরা বই নিয়ে আলোচনা করতে এবং তাদের চিন্তাভাবনা শেয়ার করতে পারে। শিক্ষামূলক অ্যাপ এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করা, যাতে ইন্টারেকটিভ পড়ার অনুশীলন এবং কুইজের মাধ্যমে করে তাদের জানার আগ্রহ বাড়াতে সাহায্য করবে।
নিয়মিত মূল্যায়ন: অগ্রগতি নিরীক্ষণের জন্য নিয়মিত পড়ার মূল্যায়ন পরিচালনা করা এবং উন্নতির প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে ফলাবর্তন প্রদান করা।
পড়ার চ্যালেঞ্জ এবং উদ্দীপনা: শিক্ষার্থীদের আরও পড়তে অনুপ্রাণিত করতে পড়ার চ্যালেঞ্জ বা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা। পড়ার লক্ষ্য অর্জনের জন্য পুরস্কার বা প্রণোদনার ব্যবস্থা করা।
মা-বাবার সম্পৃক্ততা: মা-বাবাকে তাদের সন্তানদের সঙ্গে বাড়িতে পড়তে উৎসাহিত করতে হবে এবং অভিভাবকদের সঙ্গে পড়ার বিভিন্ন কৌশল শেয়ার করতে হবে।
পড়া উদ্যাপন করা: স্বীকৃতি ও পুরস্কারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পড়া ও অর্জন উদ্যাপন করা, যেমন পড়া উৎসব উদ্যাপন।
মনে রাখতে হবে যে প্রত্যেক ছাত্র অনন্য এবং তাদের ব্যক্তিগত চাহিদা এবং আগ্রহের জন্য আপনার পদ্ধতিগুলো অতি গুরুত্বপূর্ণ। পড়ার দক্ষতার উন্নতির ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা এবং ধৈর্য গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি একটি ইতিবাচক ও সহায়ক পড়ার পরিবেশ তৈরি করায় অপরিহার্য।
লেখক: রেহানা সুলতানা, সহকারী শিক্ষক, দক্ষিণ আলীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী