আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলজীবন
১৯৭৩ সালে মফস্সল থেকে আসা সাজেদুল, হাবিবসহ আমাদের তিন বন্ধুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের সিদ্দিক ভাই তিন বিভাগে ভর্তি করে দিলেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলের নিজ কক্ষে ‘ফ্লোরিং’ করে থাকার ব্যবস্থাও করে দিলেন। বিষয়টা সিদ্দিক ভাইয়ের রুমমেট মৃদুলদা সম্ভবত পছন্দ করতেন না। আমরা তাই মৃদুলদা ঘুমিয়ে পড়লে গভীর রাতে চুপি চুপি মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়তাম। মৃদুলদার ঘুম ভাঙার আগেই বেরিয়ে যেতাম। বহুল প্রতীক্ষিত পুকুরপাড়ের এক্সটেনশন বিল্ডিং হওয়ার পর মেধার ভিত্তিতে সিটও পেয়ে গেলাম। এর আগে ঢাকা কলেজের এক বন্ধু মোহাম্মদ আলীর কাছেও কিছুদিন থেকেছি।
মাঝেমধ্যে কোনো কারণে অস্থিরতা দেখা দিলে হল খালি করে দিতে হতো। সময়টা খুবই কষ্টের ছিল। আমার আম্মার ফুফাতো ভাই এনায়েত মামার বাসা ছিল ‘মুসাফিরখানা’, তাই আমারও সেখানে ঠাঁই হতো। একদিন দুপুরে ডাইনিংয়ের খাবারের মূল্য চার আনা বাড়ানোর প্রতিবাদে খাবার বয়কট করা হলো। আমি সেদিন মামার বাসায় দুপুরের খাবার খেতে গিয়ে মামিকে ঘটনাটা বলতে অনেক লজ্জা পেয়েছিলাম।
আমি তখন প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক। একদিন দুপুরের পর উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের ফোন, বললেন, ‘আপনাকে অমর একুশে হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব দিচ্ছি।’ বললাম, ‘স্যার, আমি কখনো হলের হাউস টিউটরের দায়িত্বও পালন করিনি।’ যা হওয়ার তা–ই হলো। কিছুক্ষণের ভেতরে হাতে চিঠি পৌঁছে গেল। দায়িত্ব নিলাম, কিন্তু প্রতিদিন নিজের বহু কিছুর সঙ্গে যুদ্ধ করছিলাম। এর মধ্যে একদিন হল অফিসে কাজ করছি। শুনলাম, ছাত্ররা ‘সজ্জিত’ হচ্ছে কার্জন হলে যাবে। কেন? শহীদুল্লাহ হলের ছাত্ররা অমর একুশে হলের ছাত্রদের মেরেছে। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে হলের মূল ফটকে তালা লাগিয়ে দিলাম। ছাত্রদের আবদার গেট খুলে দিতেই হবে, নইলে তারা পারলে দেয়াল টপকে চলে যাবে। আমি বলেছি, ‘যেতে হলে আমার ওপর দিয়ে যেতে হবে।’
যাহোক, কিছুতেই প্রাধ্যক্ষজীবন ভালো লাগছিল না। মাস দুয়েকের ভেতর উপাচার্যকে বললাম, ‘আমার শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, অনুগ্রহ করে অব্যাহতি দিন।’ উপাচার্যের সরল উত্তর, ‘এটিও একটি একাডেমিক কাজ, আনোয়ার সাহেব।’ কেমব্রিজ ও অক্সফোর্ডের হলগুলোকে কলেজ বলা হয়। আমি কেমব্রিজে থাকতে দেখতাম, শিক্ষার্থীরা কলেজের নামেই বিশেষভাবে পরিচিত হতেন।
প্রাধ্যক্ষ হওয়ার প্রথম দিন থেকেই আমি শিক্ষার্থী ও হলের যত্ন নেওয়া শুরু করেছিলাম।উপাচার্যের ছোট্ট বাক্যটি আমাকে বহুলাংশে উজ্জীবিত করল। এরপর দীর্ঘ ছয় বছর আমি প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করি। মাঝে তিন বছর একই সঙ্গে বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করতে হয়েছে। আমার বিভাগ ও আমার অমর একুশে হল—এ দুটি আমার বর্ধিত পরিবার হয়ে গেল। কতটুকু দিতে পেরেছি জানি না, পেয়েছি অনেক বেশি। এখনো আমার সেরাদের সেরা শিক্ষার্থীরা আমাকে তাদের প্রয়োজনে ও উদ্যাপনে স্মরণ করে।
প্রাধ্যক্ষ হয়েই দেখলাম, প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা অনেকেই হল ছাড়েনি। আমার মাস্টার্সের মৌখিক পরীক্ষা হওয়ার পরদিনই আমি হল ছেড়ে দিয়েছি। কোথায় উঠব জানি না। পরীক্ষা শেষে করিম খালুজির সঙ্গে দেখা করলাম। খালুজি অফিস থেকে ফিরে বাসার কাছে হোমিওপ্যাথ প্র্যাকটিস করতেন। খালুজির রোগী দেখার বেডে রাতে থাকার ব্যবস্থা হলো। আমার মায়ের ফুফাতো বোন নাহার খালাম্মার অতুলনীয় রান্না সে সময়ে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া। কদিন আগে করিম খালুজি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তার নিথর দেহের পাশে বসে ভাবছিলাম, ঢাকার বাইরে থেকে আসা হলের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জীবনে একজন করে করিম খালুজি কেন থাকেন না?
প্রাধ্যক্ষ থাকা অবস্থায় ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। সহকর্মীদের সহযোগিতায় সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছি। নির্বাচনের ফলাফল পাঠিয়ে সারা রাত দুশ্চিন্তায় কাটিয়েছি এই ভেবে যে কোনো ভুল করিনি তো! পরদিন সকালে প্রথম আলো হাতে পেতেই স্ত্রীকে দেখালাম যেখানে লেখা ছিল, অমর একুশে হল ও শামসুন নাহার হলে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হয়েছে। আপনারা আমার অমর একুশে হলে আসবেন। দেখবেন আমার ছেলেরা, প্রাধ্যক্ষ মহোদয়, আবাসিক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সবাই মিলে হলটিতে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করার কাজটি অব্যাহত রেখেছেন। আমার প্রাধ্যক্ষজীবন যেদিন শেষ হলো, শিক্ষার্থীরা অনেক বড় সংবর্ধনার আয়োজন করল। আমার স্ত্রীসহ এক অসাধারণ সন্ধ্যা কাটালাম তাদের সঙ্গে। ভাবতে ভালো লাগে, তাদের জয় করতে পেরেছিলাম। শিক্ষার্থীদের জয় করা মোটেই কঠিন কাজ নয়।
*লেখক: মো. আনোয়ারুল ইসলাম, সাবেক অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, সাবেক প্রাধ্যক্ষ, অমর একুশে হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়