বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার ভাবনা: কতিপয় প্রস্তাব

ফাইল ছবি

দেশের পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন নানান সমস্যায় জর্জরিত, তখন বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলন–পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের সর্বত্রই সংস্কারের দাবী উঠেছে। তাই, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গতিশীল এবং শিক্ষার্থীর-বান্ধব সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন আজ সময়ের দাবী হয়ে উঠেছে। আলোচ্য লেখায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার আলোকে কতিপয় সংস্কার প্রস্তাব তুলে ধরতে চাই।

শ্রেণিকক্ষে প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার

দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিশেষত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) প্রযুক্তিনির্ভর পাঠ দান করা হয় না। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে যেমন কাঙ্ক্ষিতমাত্রায় জ্ঞানের আদান-প্রদান হয় না, তেমনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সময়ের অপচয় হয়ে থাকে। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তথ্য-উপাত্তকে সাবলীলভাবে উপস্থাপনের লক্ষ্যে অডিও এবং ভিডিওর ব্যবহার পাঠদানকে অধিকতর চিত্তাকর্ষক করে তুলে। পাশাপাশি, শিক্ষার্থীদের ফিডব্যাক পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করা হয়, যা তাৎক্ষণিক মূল্যায়নে সহায়ক। কাজেই সময়ের যথেচ্ছ ব্যবহারের পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয়ের জন্য প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার জরুরি।

অনলাইনভিত্তিক শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যোগাযোগ

প্রথাগতভাবে, দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো অফ-লাইন ভিত্তিক ইন-পারসন যোগাযোগ হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যোগাযোগের প্রধানতম মাধ্যম। যানবাহনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এবং কার্বন নিঃসরণ বিবেচনায় অফলাইন ভিত্তিক ইন-পারসন যোগাযোগের পরিবর্তে অনলাইন ভিত্তিক ই–মেইল যোগাযোগকে প্রাধান্য দেওয়া সময়ের দাবী হয়ে উঠেছে। স্টুডেন্ট কাউন্সেলিংয়ের ক্ষেত্রে অনলাইন ভিত্তিক (যেমন জুম কিংবা গুগল মিট) মিটিংয়ের ওপর জোর দেওয়া যেতে পারে। পাশ্চাত্যের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স কিংবা পিএইচডি ডিজারটেশন ডিফেন্সের ক্ষেত্রে অনলাইন প্লাটফর্মকে ব্যবহার করা হয়, যেখানে শিক্ষার্থীর সঙ্গে কমিটি সদস্যের একবারের জন্য ও ইন-পারসন দেখা মেলে না। বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো নীতিগতভাবে এটি নিষিদ্ধ। অনেক শিক্ষার্থীর এমফিল কিংবা পিএইচডি ডিগ্রি অফ-লাইন ভিত্তিক যোগাযোগের দুষ্ট চক্রে বছরের পর বছর আটকে আছে। তাই, এই চর্চাকে সংস্কার করা এখন সময়ের দাবী হয়ে উঠেছে।

আরও পড়ুন

অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষার্থী সেবা চালুকরণ

টিউশন ফি প্রদান, সার্টিফিকেট উত্তোলনসহ সব সেবা প্রদানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ওয়ান–স্টপ সেবা চালু করতে হবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণের লক্ষ্যে বিদেশ গমন করে থাকেন। এ লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের পক্ষে অফিশিয়াল ট্রান্সক্রিপ্ট বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে হয়। পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে অফিশিয়াল ট্রান্সক্রিপ্ট সেকেন্ডে উত্তোলন করা গেলেও দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তোলনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির শেষ নেই। সার্টিফিকেট উত্তোলনসহ সব সেবা প্রদানে প্রশাসনিক হয়রানি বন্ধ করতে হবে। এই লক্ষ্যে অনলাইনভিত্তিক সেবা চালু করতে হবে।

‘গ্রিন ক্যাম্পাস মডেল’ বাস্তবায়ন

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী ‘গ্রিন ক্যাম্পাস মডেল’ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। গ্রিন ক্যাম্পাসের লক্ষ্য হচ্ছে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কর্মকাণ্ডে টেকসই ধারণার প্রবর্তন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারী—সবার মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদের দক্ষ ব্যবহার, পরিবেশের মানোন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি শক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার, পানি ও বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার ইত্যাদি বাস্তবায়ন অপরিহার্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গণ চীনের টংজি বিশ্ববিদ্যালয় গ্রিন ক্যাম্পাস মডেল বাস্তবায়নে সচেষ্ট হয়েছে। পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিন ক্যাম্পাস উদ্যোগ বাস্তবায়নযোগ্য হলেও উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দুনিয়ায় সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে এটি বাস্তবায়ন অপেক্ষাকৃত কঠিন। দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে গ্রিন ক্যাম্পাস মডেলের ভিত্তিতে শিক্ষা কারিকুলাম এবং কাঠামোগত সংস্কার জরুরি।

সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমন্বিত প্রচেষ্টায় বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মর্মকে ধারণ করে জাতিকে আধুনিক ও সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় উপহার দিতে পারে।

*লেখক: মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

আরও পড়ুন
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]