যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে চীনা শিক্ষার্থীরা কেন অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেনে পড়তে যাচ্ছেন
যুক্তরাষ্ট্রে চীনা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা গত বছর কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। তাঁরা এখন যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার মতো কম ব্যয়বহুল দেশে যেতে পছন্দ করছেন। আন্তর্জাতিক সমীক্ষার একটি বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য বলা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার অতিরিক্ত খরচ, চীনের অর্থনীতি ও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা দেশটিতে চীনের শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ।
ভিনসেন্ট চেন বলেন, ‘আপনি যদি শুধু বিদেশে পড়তে চান, তাহলে যুক্তরাজ্যে এক বছরের স্নাতকোত্তর ডিগ্রির খরচ অনেক কম। অনেকের যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করার মতো সামর্থ্য নেই, এ কারণে তাঁদের বিকল্প সেরা জায়গার কথা ভাবতে হবে।’
এদিকে আন্তর্জাতিক গবেষণার বার্ষিক প্রতিবেদনে ওপেন ডোরসর বলছে, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা করোনা মহামারির পর প্রথমবারের মতো ১০ লাখ অতিক্রম করেছে। ২০২২-২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ১২ শতাংশ। তবে চীন থেকে আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা শূন্য দশমিক ২ শতাংশ কমে ২ লাখ ৮৯ হাজার ৫২৬-এ দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ শতাংশ কমে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রে এই শিক্ষাবর্ষে অন্যান্য দেশের তুলনায় চীনের শিক্ষার্থীই ছিল বেশি।
২০২২-২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি শিক্ষার্থীর দিক দিয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ভারত। এই শিক্ষাবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের ২ লাখ ৬৮ হাজার ৯২৩ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেছেন। আগের বছরের তুলনায় এ–সংক্রান্ত ৩৫ শতাংশ বেশি।
২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ৯ শতাংশ কমেছে। করোনা মহামারিতে এই শিক্ষাবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৫ শতাংশ হ্রাস পায়। এই সংখ্যা ২০২০-২১ সালে বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সমান।
সাংহাইভিত্তিক ভিনসেন্ট চেন চীনা শিক্ষার্থীদের বিদেশে পড়াশোনা করার বিষয়ে পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, তিনি যেসব শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দেন, তাঁদের অধিকাংশই এখনো যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আগ্রহী। তবে ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ায় পড়ার জন্য আবেদনকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।
ভিনসেন্ট চেন বলেন, ‘আপনি যদি শুধু বিদেশে পড়তে চান, তাহলে যুক্তরাজ্যে এক বছরের স্নাতকোত্তর ডিগ্রির খরচ অনেক কম। অনেকেরই যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করার মতো সামর্থ্য নেই, এ কারণে তাঁদের বিকল্প সেরা জায়গার কথা ভাবতে হবে।’
অলাভজনক ইউএস গ্রুপ কলেজ বোর্ড রিসার্চের তথ্যে দেখা গেছে, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রে একটি বেসরকারি কলেজের চার বছরের শিক্ষার গড় খরচ আগের শিক্ষাবর্ষের তুলনায় ৪ শতাংশ বেড়ে প্রায় ৪৯ লাখ ৬৭ হাজার ৬১৯ টাকা (৪১ হাজার ৫৪০ ডলার) হয়েছে।
চীনা শিক্ষার্থীসহ অন্য বিদেশি শিক্ষার্থীরাও যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করেন। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত বেসরকারি কলেজের তুলনায় কম ব্যয়বহুল।
ব্রিটিশ কাউন্সিল বলেছে, ব্রিটেনে তিন থেকে চার বছরের স্নাতক শিক্ষার জন্য প্রতিবছর প্রায় ১৭ লাখ ৯৩ হাজার ৭৯৬ টাকার (১৫ হাজার ডলার) মতো খরচ হয়।
ইউকে হায়ার এডুকেশন স্ট্যাটিসটিকস এজেন্সি হেসার তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ সালে ব্রিটেনে চীনা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৫৪ হাজার ২৬০ জন। এই সংখ্যা ২০১৮-১৯ সালের চেয়ে প্রায় ২২ শতাংশ বেশি। তখন এই সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২১ হাজার ১৪৫।
অস্ট্রেলিয়ার হোম অ্যাফেয়ার্স অফিস বলেছে, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে এই দেশে নতুন শিক্ষার্থী আসার দিক দিয়ে চীন ছিল শীর্ষ বিদেশি দেশ। ওই বছর অস্ট্রেলিয়ায় চীনের শিক্ষার্থী ছিল ৪৩ হাজার ৩৮৯ জন, যা এর আগের বছর থেকে কিছুটা বেশি।
পড়াশোনার জন্য চীনা শিক্ষার্থীরা ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া বেছে নেওয়ার পেছনে আরও দুটি কারণের কথা বলেছেন ভিনসেন্ট চেন। তিনি বলেন, এই কারণ দুটি হলো চীনের গণমাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক চিত্র ও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় আচরণের বিষয়ে উদ্বেগ।
চীনে পড়াশোনা করার পর ইউরোপে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন চীনা নাগরিক ব্রুস ঝাং। তিনি ভয়েস অব আমেরিকার মান্দারিন সার্ভিসকে বলেছিলেন, তিনি একটি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হওয়ার পর তাঁর সঙ্গেও এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল। এ কারণে তিনি এখন চীনের নাগরিকদের অন্য কোথাও পড়াশোনা করতে বলেন।
ব্রুস ঝাং বলেন, গত বছর তিনি যখন বোস্টনের লোগান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশ করেন, তখন কাস্টমস কর্মকর্তারা তাঁর গবেষণা সম্পর্কে এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তাঁরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে এর সঙ্গে সামরিক বাহিনীর কোনো সংযোগ আছে কিনা। কাস্টমস কর্মকর্তারা পরীক্ষার জন্য তাঁর কম্পিউটার ও মুঠোফোন নিয়ে যান।
কুই কাই যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস রাজ্যে বিদেশে অধ্যয়ন উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। তিনি ভয়েস অব আমেরিকার মান্দারিন সার্ভিসকে বলেন, ব্রুস ঝাংয়ের মতো অভিজ্ঞতা বা এর চেয়েও খারাপ অভিজ্ঞতা একটি কারণে ঘটে। তিনি বলেন, যেসব শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করা হয়েছে বা প্রবেশে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে, তাঁরা সাধারণত নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি এলাকায় উন্নত পড়াশোনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২০ সালের জুনে ১০০৪৩ ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন। এই ঘোষণাপত্র ‘মিলিটারি-সিভিল ফিউশন স্ট্র্যাটেজির’ সঙ্গে যুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা বা কাজ করেছেন, এমন যেকোনো চীনা শিক্ষার্থীকে ভিসা দিতে অস্বীকার করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, চীন গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি পেতে শিক্ষার্থী ও গবেষকদের ব্যবহার করছে। ১০০৪৩ ঘোষণাপত্রের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র চীনা নাগরিকদের দেওয়া এক হাজারের বেশি ভিসা বাতিল করেছে এবং হাজারো শিক্ষার্থীকে ভিসা দিতে অস্বীকার করেছে।
সমালোচকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে এই নীতি ব্যয়বহুল। এ কারণে চীনা শিক্ষার্থীদের বর্তমানে ইউরোপ ও অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে।