রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির থেকে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়েদোল্লাহ
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তিসহ ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন মং সায়েদোল্লাহ। উচ্চশিক্ষা নিতে দৃঢপ্রতিজ্ঞ সায়েদোল্লাহর যাত্রাটা সহজ ছিল না। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে রোহিঙ্গাশিবিরে আশ্রয় নেওয়ার পর রাষ্ট্রহীন ও পাসপোর্টহীন হয়ে পড়েন। তাই কোনো দেশের নাগরিকত্ব না থাকায় শুরুতে সায়েদোল্লাহকে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি নিতে চায়নি। একপর্যায়ে থমকে যায় উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন।
২০১৭ সালে মিয়ানমারের আরাকানে দেশটির সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা শুরু করলে জীবন বাঁচাতে ধাপে ধাপে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তাদের সঙ্গে মং সায়েদোল্লাহর পরিবারও বাংলাদেশে আসে। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি অসীম আগ্রহ ছিল। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের উচ্চশিক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বাংলাদেশে আসার পর জানতে পারেন, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়েও রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার অনুমোদন নেই।
উচ্চশিক্ষার পথে বাধা ভাঙতে রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, মানবিক সংস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বরাবর চিঠি লেখা শুরু করেন সায়েদোল্লাহ। রোহিঙ্গাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ চেয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পেইন ও আর্টিকেল লেখা শুরু করেন।
মং সায়েদোল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘শরণার্থী হওয়ার পর উপলব্ধি করলাম, আমার জন্য উচ্চশিক্ষা কঠিন। প্রথমে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ চেয়ে আবেদন করি। আমার ক্যাম্পের সবচেয়ে কাছের বিশ্ববিদ্যালয় কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে আবেদন করেছিলাম। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছেও উচ্চশিক্ষার সুযোগ চেয়ে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু কারও কাছ থেকে প্রথমে আশানুরূপ সাড়া পাইনি। লক্ষ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মাধ্যমে আমার শিক্ষা চলমান রাখা। যুক্তরাষ্ট্রেই পড়তে হবে—শুরুতে এমন কোনো লক্ষ্য ছিল না। তবে আমার লক্ষ্য ছিল ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার।’
সবার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরও হাল ছেড়ে দেননি সায়েদোল্লাহ। তিনি বলেন, ‘আমি শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছি মানে বিষয়টা এমন নয় যে ইচ্ছেমতো একবারে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছি। এক জায়গা থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছি। যেমন প্রথমে আমি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু সেখানকার রিকয়ারমেন্ট ফুলফিল করতে না পারায় আমি ভর্তি হতে পারিনি। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছিলাম, এর মধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তির অফার পাই। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয় কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও আয়ারল্যান্ডের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছিলাম। কারণ, আমার প্রধান লক্ষ্য ছিল উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাওয়া নিশ্চিত করা।’
মং সায়েদোল্লাহকে অভিনন্দন জানিয়ে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস তাদের ফেসবুকে পেজে একটি পোস্ট দিয়েছিল। সেখানে লিখেছে, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীকে অভিনন্দন। অভিনন্দন মং সায়েদোল্লাহ। গণহত্যার বিভীষিকা থেকে উঠে এসে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার পর নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন তিনি। আপনার অটল প্রতিশ্রুতি সহিষ্ণুতা ও দৃঢ়তার প্রমাণ। আপনার গল্প অন্যদের অনুপ্রেরণা জোগাক এবং রোহিঙ্গা জনগণের জন্য মর্যাদা ও ন্যায়ের পথ প্রশস্ত করুক।’
সায়েদোল্লাহর উচ্চশিক্ষায় যাঁরা তাঁর পাশে ছিলেন, তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে মং সায়েদোল্লাহ বলেন, ‘আমার উচ্চশিক্ষার যাত্রায় যাঁরা আমাকে সহযোগিতা করেছেন, আমি তাঁদের সবার কাছে কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। কারণ, সরকার আমার সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স না দিলে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসা সম্ভব হতো না। এ ছাড়া ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কাছে কৃতজ্ঞ আমার পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে আমাকে পাসপোর্ট ছাড়াই ভিসা দেওয়ার জন্য।’