নতুন বাংলাদেশ এবং এর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কিছু কথা
ছাত্র–জনতার এক অভ্যুত্থানে শাসক দলকে বিদায় নিতে হয়েছে। দেশের ক্রান্তিলগ্নে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। আইনের শাসন, মানবাধিকার ও নিরাপদ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে ছাত্রসমাজ, আমজনতা। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এ সরকারের প্রতি শুভকামনা।
অসাম্প্রদায়িক, সুন্দর, ন্যয়–নিষ্ঠাসম্পন্ন সমাজ গঠন করার জন্য মানসিকতা, মূল্যবোধ ইত্যাদিতে পরিবর্তন আনা সর্বাগ্রে জরুরি। মনন আর মানসিকতা যদি পরিবর্তন না হয়, রুচিবোধ যদি পরিবর্তন না হয়, চিন্তার যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে একটি সভ্য সমাজ তৈরি করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ হবে। চিন্তা আর মনন গঠনের জন্য সর্বপ্রথম আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।
বাংলাদেশে মোটামুটি চার ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত আছে। যথা—
আলিয়া
কওমি
সাধারণ শিক্ষা
ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা
ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমি আজ কোনো কথা লিখতে চাই না। কারণ, বিদেশি কারিকুলাম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও উন্নত কারিকুলামের পর্যাপ্ত রিসোর্স থাকার ফলে বাংলাদেশে এটি ভালোভাবেই চলমান আছে।
কওমি শিক্ষাব্যবস্থাকে আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী কারিকুলাম স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে যদি তৈরি না করি, তাহলে আমাদের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী অদক্ষ থেকে যাবে। ধর্মীয় শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে বিদেশি কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্কের যে কাঠামো, সেই কাঠামোয় আমাদের ন্যাশনাল কারিকুলামের সঙ্গে সমন্বয় করে দক্ষতা, মূল্যবোধ, মানসিকতা তৈরি করার উপযোগী বিষয় সংযুক্ত করে যদি সংস্করণ করি, তাহলে বৃহৎ এ জনশক্তি কর্মশক্তিতে যুক্ত হবে। এখানে রেগুলেটরি অথরিটি তৈরি করে মান নিশ্চিত করা খুব জরুরি।
এ শিক্ষাব্যবস্থাকে হালনাগাদ করে সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে সমন্বয় করে বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে আমাদের কর্মশক্তিতে রূপান্তর করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা হাতে নেওয়া এখন ফরজ হয়েছে। যেসব দুর্বলতা রয়েছে এবং যেখানে উন্নতি করতে হবে, এ ব্যবস্থাকে কীভাবে সাজাতে হবে, এগুলোর জন্য উচ্চপর্যায়ের একটি স্ট্যান্ডিং কমিটি তৈরি করে কমিটির গবেষণালব্ধ ফলাফল এবং মানোন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ তৈরি করে অথরিটির মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্নভাবে সেটা করা যাবে, আজকে সেগুলো নিয়ে আমি বিস্তারিত বলছি না।
আরেকটি বিশেষায়িত শিক্ষা চলমান আছে, সেটাকে হাফেজি শিক্ষা বলা হয়। হাফেজি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীরা শুধু পবিত্র কোরআনের হাফেজ হয় বা কোরআন হিফজ করে। ফলে এই কোরআনের হিফজ যেসব প্রতিষ্ঠানে থাকবে বা যেসব প্রতিষ্ঠান শুধু কোরআনের হিফজ করাবে, সেসব প্রতিষ্ঠানে কোরআনের হিফজের পাশাপাশি তার কিছু ন্যূনতম মৌলিক জ্ঞানের জন্য কিছু বিষয় যুক্ত করে একটি বিশেষায়িত শিক্ষাক্রম করে দেওয়া। এর জন্য একক রেগুলেটরি অথরিটি থাকা আবশ্যক। এটা নিশ্চিত করা যে যারা এসব মাদ্রাসায় কোরআনুল করিমের হিফজ করবে, পড়া শেষ হওয়ার পরে যেন তারা মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় পরিপূর্ণভাবে যুক্ত হতে পারে অথবা স্কুল-কলেজের শিক্ষাব্যবস্থায় এসে যুক্ত হতে পারে।
এ ছাড়া এই হিফজুল কোরআন যেহেতু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, ফলে এটিকে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান না করেও যে কেউ চাইলে যাতে এই কোরআন অধ্যয়ন করতে পারে, কারিকুলাম বা শিক্ষাব্যবস্থায় এ সুযোগ থাকা দরকার। আমরা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে দেখি, বিশেষ করে সৌদি আরব, মিসরে প্রাইমারি স্কুলের কারিকুলামে আল কোরআনকে একটি বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে, ফলে শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কোরআনুল করিম পড়ছে বা হিফজ করছে।
ফলে যারা স্কুল–কলেজে পড়াশোনা করছে, তারাও কোরআনুল করিম পড়ার সুযোগ পাচ্ছে, কোরআনের হাফেজ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এমনকি ব্রিটিশ কারিকুলামেও আপনি বাধ্যতামূলক বিষয় গণিত, ইংরেজি ও বিজ্ঞানের সঙ্গে যেকোনো জেনারেল বা বিশেষায়িত বিষয় যুক্ত করে পড়ানোর সুযোগ রয়েছে। আমাদের দেশেও প্রাইমারি পর্যায়ে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা যেতে পারে।
এবার সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার কথায় আসি। অতি সম্প্রতি তিনটি পরিবর্তন আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় দেখতে পাই। প্রথম পরিবর্তনটি আসে ১৯৯৬ সালে। দ্বিতীয় পরিবর্তনটি আসে ২০১২ সালে এবং তৃতীয় পরিবর্তনটি আসে ২০২১ সালে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ২০১২ ও ১৯৯৬ সালে, অর্থাৎ আগের দুটি পরিবর্তন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। সর্বশেষ যে পরিবর্তন হয়েছে ২০২১ সালে, এ পরিবর্তনও অত্যন্ত সমালোচিত সুধী মহলে, শিক্ষক মহলে, অভিভাবক মহলে। ইতিমধ্যে অনেক দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়েছে। কারণ, তৃতীয় পরিবর্তনের কিছু ত্রুটি স্পষ্ট। প্রথমত, কোনো দেশের কারিকুলাম একসঙ্গে শতভাগ পরিবর্তন করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, কারিকুলামটি সারা পৃথিবীতে প্রচলিত নয়।
তৃতীয়ত, এ কারিকুলাম পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে ইউরোপ ও কানাডার মতো দেশের কিছু কিছু প্রদেশে চলমান আছে। চতুর্থত, এটি আন্তর্জাতিকভাবে বহুল ব্যবহৃত কারিকুলাম নয়। পঞ্চমত, এ কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য যে ধরনের অবকাঠামো, যে ধরনের শিক্ষা উপকরণ, নীতিমালা এবং যে ধরনের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, সে ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো রিসোর্স বা ব্যবস্থাপনা আমাদের নেই। ফলে বাস্তবায়ন করতে চাইলেও পূর্ণাঙ্গভাবে তা পারবেন না। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমরা কোনোভাবেই প্রস্তুত নই এ কারিকুলাম বা বাস্তবায়ন করার জন্য। ষষ্ঠত, মূল্যায়নব্যবস্থা যথেষ্ঠ ত্রুটিপূর্ণ। এ ছাড়া এই কারিকুলাম প্রণয়নের সময় যেসব গবেষণা সম্পন্ন করা হয়েছে, সেগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।
আমরা যদি উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সত্যিকার অর্থে একটি টেকসই কারিকুলাম বা টেকসই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে একটি সভ্য, নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন একটি সমাজ গঠন করতে চাই, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে মোকাবিলা করার উপযোগী নাগরিক তৈরি করতে চাই, তাহলে দক্ষতা ও নৈতিকতা—এ দুইয়ের সমন্বয়ে সময়োপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এর জন্য বর্তমান এনসিবিটিকে ঢেলে সাজাতে হবে। অভিজ্ঞ, যোগ্য, যাঁদের বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে—এমন মানুষকে দিয়ে এনসিটিবির একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা যেতে পারে। ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা সারা পৃথিবীতে সমাদৃত এবং সারা পৃথিবীতেই ব্রিটিশরা তাদের কারিকুলাম পরিচালনা করে আসছে। আমরা বিজ্ঞান, গণিত ও ইংরেজি—তিনটি বিষয়ের জন্য ব্রিটিশ কারিকুলাম থেকে গ্রহণ করতে পারি। বাকি যে বিষয়গুলো আছে, সেগুলোর কারিকুলাম আমরা নিজেরাই তৈরি করতে পারি। অনেক দেশ তাদের ন্যাশনাল কারিকুলামে ব্রিটিশ কারিকুলামকে গ্রহণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সিঙ্গাপুর ও ব্রুনাইয়ের কথা।
মানসম্মত ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কারিকুলাম তৈরি করা হয়ে গেলে এর বাস্তবায়নের জন্য আমাদের অবকাঠামোগত কিছু পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। তার মধ্যে জিডিপির ন্যূনতম ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া, শিক্ষকদের জন্য আলাদা একটি কমিশন গঠন করা, শিক্ষকদের আমলাতন্ত্র থেকে আলাদা রাখা, তাঁদের আলাদা কাঠামো, আলাদা মর্যাদা, আলাদা বেতনকাঠামো—সবকিছু বিশেষায়িত করতে হবে। নিয়োগপ্রক্রিয়াকে এমন স্বচ্ছভাবে সাজাতে হবে, যাতে কোনো ধরনের রাজনৈতিক বিবেচনায় অথবা কোনো তদবির কোনো কিছুতেই প্রভাবিত না হয়। মেধাবী শিক্ষার্থীরা যেন শিক্ষকতায় আসেন, এ জন্য সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করা।
শিক্ষকদের জন্য দুই বছরের এন্ট্রি ডিপ্লোমা ডিগ্রি বাধ্যতামূলক করা, যা ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় বিদ্যমান। শিক্ষকতায় আসতে হলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য বিশেষায়িত ডিপ্লোমা, মাধ্যমিকের শিক্ষক হতে হলে বিশেষায়িত উপযোগী ডিপ্লোমা এবং উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষক হতে হলে বিশেষায়িত ডিপ্লোমা করতে হবে। দরকার পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রশিক্ষণ কলেজ প্রতিষ্ঠা করা। বিদ্যমান কলেজগুলো সচল করা। প্রতিবছর একজন শিক্ষক কত দিন বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ নেবেন, এগুলো নির্ধারণ করে নীতিমালা তৈরি করা।
বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন করা, বিশেষ করে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসা। স্কুল ব্যবস্থাপনায় সফটওয়্যারের মাধ্যমে স্কুল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম নিয়ে আসা। ক্লাসরুমে সফটওয়্যারভিত্তিক শিক্ষা চালু করা, শিক্ষকদের ডিজিটাল লিটারেসির অন্তর্ভুক্ত করা, টিচিং অ্যান্ড লার্নিং প্রক্রিয়াকে অটোমেশনের মধ্যে নিয়ে আসা। এভাবে বিশেষ করে উন্নত বিশ্ব যেভাবে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত করছে, সেগুলো গ্রহণ করা।
এবার আসি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে। স্কুল কারিকুলামে যেভাবে একের পর এক পরীক্ষা চালিয়েছে, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একেবারে বিপরীত। ৩০ থেকে ৪০ বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যেসব কোর্স পড়ানো হতো, এখন পর্যন্ত সেগুলোই চলমান, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার মতো নাগরিক তৈরি করার জন্য অভিজ্ঞতা দরকার, সেই আলোকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুব কমই আপগ্রেডিশন বা সংস্করণ করেছে। এখন সময় এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনার্স ও মাস্টার্সে যেসব কোর্স পড়ানো হয়, সেগুলোয় এ সময়ের উপযোগী নতুন কোর্স সংযোজন করা, যাতে পড়াশোনা শেষে যেকোনো সেক্টরে কাজ করার জন্য ন্যূনতম একটি ভিত্তি তৈরি হয়।
প্রচণ্ড মেধাবী ছাত্রছাত্রী থাকা সত্ত্বেও দিন দিন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান ক্রমে নিম্নগামী হচ্ছে। অপরাজনীতি, দলীয়করণ, রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ, গবেষণায় বরাদ্দ না থাকা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন না থাকা, সর্বোপরি সরকারের বাজেট পরিকল্পনায় পর্যাপ্ত পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ না থাকা ইত্যাদির কারণে উচ্চশিক্ষার মান দিন দিন নিম্নগামী হচ্ছে। পুরোনো কোর্সের সঙ্গে সময়োপযোগী কোর্স তৈরি করা, শ্রমবাজারের চাহিদা মোতাবেক কোর্স ডিজাইন করা এবং সে অনুযায়ী কনটেন্ট তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম ও পোস্টগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামকে সময়োপযোগী করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আর লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি বন্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদগুলোকে কার্যকর করতে হবে। শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়ার পরিবর্তন আনাও জরুরি।
অন্তর্বর্তী সরকার এটুকু করতে পারলেই নতুন একটি দিগন্তের পথে হাঁটা শুরু হবে বলে বিশ্বাস করি।
লেখক: আবদুল্লাহ জামান, প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ উইটন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা