শিক্ষকের মর্যাদা এবং চলমান আন্দোলন
থাইল্যান্ডের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এআইটি) আমার ক্লাসমেটদের মধ্যে তিনজন শিক্ষকতা পেশায়। অন্যরা সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে বিভিন্ন খাতে কর্মরত। কিছু সদ্য পাস করা স্নাতকও আছে। যেহেতু ছাত্র হয়ে পড়তে এসেছি, খুব বাধ্য বা কেউ জিজ্ঞাসা না করলে বাংলাদেশে কী করি, কাউকে বলি না। তবে ক্লাসমেটরা সবাই জানে। এখানে আমরা সবাই ছাত্র, এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয়!
গত বছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবসে আমি থাইল্যান্ডে ছিলাম। আমরা ক্লাসমেটরা সবাই মিলে আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের জন্য বিশেষ আয়োজন করেছিলাম। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম, আমার অন্য ক্লাসমেটরা শিক্ষকদের সঙ্গে আমাদের তিনজনের জন্যও আলাদা আয়োজন করেছিল। কৌতূহলবশত জিজ্ঞাসা করলাম, আমরা তো এখন শিক্ষার্থী, আমাদের জন্য এ আয়োজন কেন? তারা বলেই ফেলল, আমরা নাকি শিক্ষক! তাদের দেশে শিক্ষকদের সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়। সেই হিসেবে যেহেতু আমরা আমাদের নিজ দেশে নেই, বন্ধুদের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যই এ সামান্য আয়োজন। আমার যে সেদিন এত ভালো লেগেছিল, তা ভাষায় বলার মতো নয়। এবার তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের দেশে কি এ রকম নয়? যেহেতু নিজের দেশের দুর্নাম বিদেশে করা ঠিক নয়, আমি টেকনিক্যালি জবাব দিয়েছিলাম, হ্যাঁ, শিক্ষকদের অবস্থান খুব সম্মানিত জায়গায়, আর সুযোগ-সুবিধার বিষয়টা এড়িয়ে গেলাম। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে যে কী আছে, সেটা তো আমি ছাড়া কেউ জানে না, কী চাপা ক্ষোভ!
কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়েছে।
অনেকেই আন্দোলনের বিরোধিতা করছেন, অনেকেই আবার পক্ষ নিচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, এটা অযৌক্তিক দাবি। যাঁরা বলছেন, তাঁরা না জেনে বলছেন বলেই বিশ্বাস করি। অনেকে ছাত্র-শিক্ষককে মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছেন। আজ যে ছাত্র শিক্ষকের আন্দোলনকে অযৌক্তিক বলছেন, কাল তিনি যখন পেশাগত জীবনে যাবেন, তখন তিনি ঠিকই বুঝতে পারবেন আন্দোলনটা কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল; শুধু বর্তমান শিক্ষকদের জন্য, নাকি ভবিষ্যৎ শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার জন্য। এটা শিক্ষার মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক খাতকে বাঁচানোর আন্দোলন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শিক্ষকদের আলাদা বেতন স্কেল দেওয়া। শিক্ষকেরা নিজেদের কারও সঙ্গে তুলনা করতে চান না। সরকার যাকে যা খুশি দিক, তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই, কিন্তু শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সম্মানিত করুক। দয়া করে শিক্ষাব্যবস্থার আর ক্ষতি করবেন না। দেশের সামগ্রিক দিক বিবেচনায় শিক্ষকদের বাঁচান, শিক্ষাকে বাঁচান।
যেকোনো দাবি আদায়ে কঠোর কর্মসূচি না হলে কর্তৃপক্ষ কখনো নড়েচড়ে বসে না। এত দিন বিবৃতি, মানববন্ধন, স্বাক্ষর সংগ্রহসহ বিভিন্ন নরম কর্মসূচি ছিল। এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। দুঃখ একটাই, শিক্ষকদের আজ রাস্তায় নামতে বাধ্য করা হচ্ছে।
লেখক: মীর মোকাদ্দেস আলী, সহকারী অধ্যাপক (শিক্ষাছুটিতে), আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও মাস্টার্স শিক্ষার্থী, এআইটি, থাইল্যান্ড