গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা শতভাগ সফল হোক
২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো দেশের ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যেরা গুচ্ছ পদ্ধতিতে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের জন্য ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো না আসায় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা শতভাগ সফল হচ্ছে না, তাই সরকারকে বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একটি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের কষ্ট কমে যাবে। কারণ, শিক্ষার্থীদের এখনো প্রায় পাঁচ-ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম তুলতে হয় ও পরীক্ষা দিতে হয়। তাই পূর্বের মতো ভোগান্তি থেকে যায়। যদিও গুচ্ছ পদ্ধতির এ পরীক্ষায় একটি আবেদনে গুচ্ছের আওতাভুক্ত সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ থাকছে। প্রথম ১৭ অক্টোবর বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের দিয়ে পরীক্ষা শুরু হয়। এরপর ২৪ তারিখ ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। আগামী ১ নভেম্বর ‘সি’ ইউনিটের পরীক্ষার মাধ্যমে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা শেষ হবে। বেশ কয়েক বছর ধরেই গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে আলোচনা চলছিল। অবশেষে যখন সত্যিই এ পদ্ধতি আংশিক বাস্তবায়িত হলো, তা পরীক্ষার্থীদের জন্য কিছুটা হলে স্বস্তি নিয়ে আসছে।
গুচ্ছভুক্ত ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা একসঙ্গে হওয়ায় আসন নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কম। আগে একজন শিক্ষার্থী কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাতালিকায় সুযোগ পেয়ে যখন পছন্দের একটি বেছে নিতেন, তখন একই সঙ্গে অন্য জায়গায় কয়েকটা আসন ফাঁকা থেকে যেত। কিছু ক্ষেত্রে পছন্দের বিষয় পেতে দেরি হতো এবং প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ ছিল। ফলে অনেকেই হতাশায় ভুগতেন। এখনকার পদ্ধতিতে আশা করি, এ সমস্যাগুলোর সমাধান হবে। তবে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে।
যেমন কেউ পছন্দ দিয়েছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, কিন্তু তাঁকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়েছে দূরবর্তী অন্য কোনো কেন্দ্রে। আবার কেউ পরীক্ষার কেন্দ্র পছন্দ দিয়েছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বাস্তবে পরীক্ষার কেন্দ্র পড়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই এভাবে অনেক শিক্ষার্থী কষ্ট এবং ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। ফলে আগামী বছর ভর্তি পরীক্ষায় বিষয়টি গুরুত্বের সহিত বিবেচনা করে সমাধান করতে হবে কর্তৃপক্ষকে।
তারপরও গুচ্ছ পদ্ধতি ভোগান্তি কমানোর জন্য একটি যুগোপযোগী পদক্ষেপ। তবে কিছু বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে আরও যত্নবান হতে হবে। আবেদন নির্দেশিকাতে বলা হয়েছিল, পছন্দক্রম অনুসারে কমপক্ষে পাঁচটি কেন্দ্র নির্বাচন করতে, যেখানে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে চান। তবে তাঁরা সঠিকভাবে কেন্দ্রের তালিকা পূরণ করার পরও অনেক শিক্ষার্থী পছন্দের কেন্দ্র পাননি। ফলে করোনা মহামারিতে অনেকেই দূরের কোনো জেলায় পরীক্ষা দিতে গিয়ে কষ্টের শিকার হচ্ছেন।
অতীতে একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য একেক জেলায় বা বিভাগে শিক্ষার্থীদের ছুটতে হতো। স্বাভাবিকভাবেই ভ্রমণক্লান্তি বা অসুস্থতার জন্য প্রস্তুতি থাকার পরও অনেকের পরীক্ষা আশানুরূপ হতো না। তাই গুচ্ছ পদ্ধতি সবার জন্যই স্বস্তির বিষয়। সময় ও অর্থসাশ্রয়ের সঙ্গে পছন্দের কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে পারলে আত্মবিশ্বাসও বাড়বে বলে মনে করি।
তবে অনেকে বড় চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতেন, এগুলোতে সুযোগ না হলে তাঁদের ঘুরতে হতো সারা দেশে। গুচ্ছ পদ্ধতি আশপাশের কোনো কেন্দ্রে বসে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ করে দিয়েছে অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের। যাঁরা প্রথম পছন্দের কেন্দ্র পেয়ে গেছেন, তাঁরা বেশি স্বস্তি পেয়েছেন।
এ ছাড়া ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা ছবি পরিবর্তনসহ অন্য কোনো সমস্যায় পড়লে তাঁদের গুচ্ছভুক্ত কাছাকাছি যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করে তা সমাধান করা হয়েছে। শিক্ষকেরাও গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন, কারণ, প্রতি কক্ষে প্রধান পরিদর্শক রাখা হয়নি, রাখা হয়েছে ফ্লোর ইনচার্জ, ফলে সমন্বয়হীনতা দেখা গিয়েছে। একই সময় দুটি কক্ষে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তখন ফ্লোর ইনচার্জ বেকায়দায় পড়ে যান। তাই প্রতি কক্ষে প্রধান পরিদর্শক থাকলে এ সমস্যা হবে না এবং ফ্লোর ইনচার্জ রাখার কোনো প্রয়োজন নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা গুচ্ছ পদ্ধতিতে হলে, শিক্ষার্থীরা শতভাগ খুশি হতো। কারণ, এতে এক আবেদনে তাঁদের ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন হতো। অনেক শিক্ষার্থী মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এ প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত না হওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। তাঁরা মনে করেন, সব বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় এলে সবচেয়ে ভালো হতো। নতুবা ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অজুহাতে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় ভবিষ্যতে না–ও থাকতে পারে। তবে নতুন এ ব্যবস্থাকে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা। আশা করছি, এ পদ্ধতিতে পুরোনো সমস্যাগুলো দূর হতে পারে। এ ছাড়া গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার নেতিবাচক দিক হলো, যদি কোনো এক শিক্ষার্থী দুর্ঘটনাবসত পরীক্ষা দিতে না পারেন বা পরীক্ষায় বেশি খারাপ করে ফেলেন, তাহলে তাঁর গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ আর থাকবে না। আগে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে খারাপ করলেও আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ভালো পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি হওয়ার সুযোগ মিলত।
পছন্দক্রম অনুযায়ী আসন না পড়ায় ভর্তি-ইচ্ছুকদের বড় একটি অংশ আসনবিন্যাসের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমন কেন্দ্রে আসন পড়েছে, যেখানে অনেকে অতীতে কখনো যাননি। এ ছাড়া পছন্দমতো যদি আসন দিতে না পারে, তাহলে পছন্দক্রম পদ্ধতি রাখার মানে হয় না। ফলে ভোগান্তি, হয়রানি ও অর্থ খরচ কমাতে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করা হলেও প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি বেড়েছে। কারণ, হঠাৎ চূড়ান্ত আবেদন ফি ৬০০ থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ২০০ টাকা করা হয়েছে। যদিও এটা বেশি নয় বলে মনে করছি, কারণ, ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা ফরমে আবেদন করলে এর চেয়ে বেশি অর্থ খরচ হতো।
তবে কর্তৃপক্ষ মনে করে কেন্দ্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভর্তি-ইচ্ছুকদের স্কুল, কলেজের অবস্থানসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির ওপর ভিত্তি করে ১০০ নম্বরের মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের প্রাপ্ত স্কোর ও কেন্দ্রের পছন্দক্রমের ভিত্তিতে পরীক্ষা কেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়েছে। সবকিছুই সফটওয়্যারের মাধ্যমে হয়েছে। এতে কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আয়োজক কমিটির মতে, এ রকম শিক্ষার্থীর সংখ্যা মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ১০ শতাংশের মতো হবে। তাদের মতে, অধিকাংশ শিক্ষার্থী রাজধানীতে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রগুলোতে পরীক্ষা দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ হাজার ৯১৫ জনের পরীক্ষা নেওয়ার ধারণক্ষমতা আছে, কিন্তু সেখানে ৩৭ হাজার ৭৪৯ জন শিক্ষার্থী প্রথম পছন্দের কেন্দ্র হিসেবে আবেদন করেছেন। আবার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ হাজার জনের পরীক্ষা নেওয়ার ধারণক্ষমতা থাকলেও সেখানে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আবেদন জমা পড়েছে ২০ হাজার ৮৯৪ জনের। ফলে নির্ধারিত আসনের বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী পছন্দ থাকায় যাঁরা স্কোরে এগিয়ে ছিলেন, তাঁরাই ওই কেন্দ্রে পরীক্ষার আসন পেয়েছেন।
দেশে অনুমোদিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫১টি। ২০টি সাধারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা তিন দিনে তিনটি ইউনিটের মাধ্যমে সম্পন্ন হতে যাচ্ছে আগামী ১ নভেম্বর। তিন প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হবে ১৩ নভেম্বর। এ ছাড়া কৃষি ও কৃষিপ্রধান সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হবে ২৭ নভেম্বর। অন্যদিকে বুয়েটসহ বড় পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা আলাদা আলাদা তারিখে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি প্রকৃতপক্ষে ওই রকম হ্রাস পাচ্ছে না। অর্থাৎ গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা সফল হবে তখনই, যখন একটি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হবে ৫১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।
লেখক: সাবেক সভাপতি-শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় (জাককানইবি), ত্রিশাল, ময়মনসিংহ