আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কোন দিকে যাচ্ছে

প্রথম আলো ফাইল ছবি

একটা দেশের ভবিষ্যৎ চাহিদা, সমস্যা, সংকট ও সম্ভাবনা মাথায় রেখে গড়ে তোলা হয় সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। একজন নাগরিককে তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও পেশাগত জীবনের দায়িত্ব পালনে সক্ষম করে তোলাই এ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। আর এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে পরিকল্পিত কর্মকাঠামো তৈরি করা হয়, সেটা হলো কারিকুলাম বা পাঠ্যক্রম। পাঠ্যক্রমে থাকে সিলেবাস বা শিক্ষার্থীরা কী পড়বে তার তালিকা, শেখানোর নিয়ম–কানুন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি।

একটি দেশের পাঠ্যক্রমে কী কী বিষয় থাকা উচিত, সেটা নির্ধারিত হয় সে দেশের সমস্যা, সংকট, চাহিদা ও সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে, যা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম। এমনকি একটা বড় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যেও এগুলো আলাদা হতে পারে। সময়ের ব্যবধানে সেটাও পরিবর্তিত হয়।

আমাদের দেশের সমস্যা, সংকট, চাহিদা, সম্ভাবনা ও সামর্থ্য কী, তা নিয়ে কি কখনো বৃহৎ পরিসরে গবেষণা হয়েছে? আমাদের ‘জাতীয় পাঠ্যক্রম ও টেক্সটবুক বোর্ড’ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিসের ভিত্তিতে নিয়মিত সিলেবাস পরিমার্জন করে? এসব পাঠ্যক্রম দিয়ে কি আমরা উপযুক্ত নাগরিক তৈরি করতে পেরেছি?

বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবাদাতাদের আচরণ, ভদ্রতাবোধ, সততা, কাজের দক্ষতা ও আন্তরিকতায় পেশাদারত্ব বিবেচনা করলে উত্তরটা জানা যায়; আমাদের অপেশাদারত্ব ধরা পড়ে। সেবাগ্রহীতাও একই রকম পরিচয়ের স্বাক্ষর রাখেন, কারণ আমরা সবাই একই শিক্ষাব্যবস্থার ফসল। শুধু চাকরিজীবী নন, প্রায় সব পেশাজীবীর মধ্যেই এ ঘাটতি রয়েছে। নিউইয়র্কভিত্তিক সিইও-ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিন (CEO WORLD MAGAZINE) ২০২০ সালে সেরা শিক্ষাপদ্ধতির দেশগুলোর একটা তালিকা তৈরি করে। এ তালিকার ৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো স্থান নেই, যদিও এ তালিকায় মিয়ানমার, মালদ্বীপ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভারত স্থান পেয়েছে। এতে বোঝা যায়, পর্যাপ্ত সুনাগরিক তৈরির উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা আমরা এখনো তৈরি করতে পারেনি।

ছবি: সংগৃহীত

অনেক সময় বিচ্ছিন্নভাবে দু-একজন সুনাগরিক তৈরি হয়। কিন্তু একটা দেশের টেকসই ও সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে দু-একজন সুনাগরিক যথেষ্ট নয়। এ জন্য বিপুলসংখ্যক সৎ ও দক্ষ নাগরিক প্রয়োজন, যা তৈরি করতে হলে ভালো ও কার্যোপযোগী পাঠ্যক্রম প্রণয়ন ও তার সফল বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

এ বিপুলসংখ্যক সুনাগরিক বিচ্ছিন্নভাবে তৈরি হয় না। রাষ্ট্রীয়ভাবে সুনাগরিক তৈরির প্রক্রিয়াকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হয়, যা শুরু হয় প্রাথমিক স্তর থেকেই। স্নাতক বা স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষার্থীরা জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জন করে; সহজাত সৎ প্রবৃত্তি গড়ে না। এটা শৈশবে গঠিত হয়। তাই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সদ্‌গুণাবলির চর্চাকে দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত করার উদ্যোগ এ স্তরেই গ্রহণ করতে হবে।

কিন্তু বাংলাদেশের সমস্যা, সংকট, সম্ভাবনা ও সামর্থ্যকে মাথায় রেখে বাংলাদেশি নাগরিকের কী কী সদ্‌গুণাবলি অর্জন করা উচিত, যা তার দৈনন্দিন অভ্যাসের অংশ হওয়া উচিত, তার কোনো সুপরিকল্পিত ব্যাপক গবেষণা বাংলাদেশে হয়নি। বাংলাদেশি একজন শিক্ষার্থী যেন সুস্থ, দক্ষ, বিনয়ী, মানবিক ও বিবেকবান হয়ে ওঠে, তার জন্য কোনো কিছু কি আমরা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছি? আমরা সুকুমার রায়ের ‘জীবনের হিসাব’ কবিতার মতো শহুরে বাবু তৈরি করছি, যাদের অনেক কেতাবি জ্ঞান আছে, কিন্তু কাজের বেলায় অথর্ব।

বাংলাদেশের শিশুদের পাঠ্যক্রম কেমন ও তা কীভাবে বাস্তবায়ন করা হয়, তা বোঝার জন্য জাপান ও নেদারল্যান্ডসের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে দু-একটা বিষয় এখানে তুলে ধরছি।

জাপানের শিশু শিক্ষার্থীরা যা যা করে

জাপানে শিশুকে তার ক্যাচমেন্ট এরিয়ার স্কুলে ভর্তি হওয়া বাধ্যতামূলক। অভিভাবক যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, ক্যাচমেন্ট এরিয়ার বাইরে শিশুকে ভর্তি করানো যাবে না। সরকারি স্কুলের সব শিশুকে পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতে হয়। সাইকেলও ব্যবহার করা যাবে না। এখান থেকে একজন শিশুর মনে সমতা ও সাম্যের ধারণা গেঁথে যায়। শরীর সুস্থ রাখার জন্য শারীরিক পরিশ্রমের প্রাথমিক অভ্যাসটিও গড়ে ওঠে। পাঠ্যবইয়ের জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি সঠিকভাবে নিজের জুতা-মোজা পরা, দাঁত ব্রাশ করা, নিজের কাপড়চোপড় ও বাসনকোসন নিজে পরিষ্কার করা, ব্যাগ ও বই ঠিক জায়গায় গুছিয়ে রাখা, রান্না শেখা, মেহমানের সঙ্গে সঠিক সামাজিক আচরণ করা, পরোপকার করা, প্রতিদিন নিয়মিত খেলাধুলা করা, সঠিক নিয়মে রাস্তাঘাটে চলা, প্রতিবার খাবার গ্রহণের আগে তার প্রস্তুতকারী ও উৎপাদনকারীকে কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জানানো, টয়লেট থেকে শুরু করে পুরো স্কুল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, চাষবাস শেখা ইত্যাদি নানা ধরনের কাজ শিশুদের শেখানো হয়, যা বাস্তব জীবনে কোনো না কোনো সময়ে কাজে লাগে। শিক্ষার্থীদের পাঠের প্রতি প্রকৃত আগ্রহ জাগিয়ে তোলার জন্য প্রতিটা ক্লাসের আগে সেটা শেখা কেন প্রয়োজন, তা বুঝিয়ে বলা হয়।

প্রথম আলো

নেদারল্যান্ডসের শিক্ষার্থী কী করে

নেদারল্যান্ডসের স্কুলে শিক্ষার্থীদের নতুন ক্লাসে ওঠার আগে নির্দিষ্ট কিছু প্রায়োগিক দক্ষতা অর্জন করতে হয় যেমন, জুতার ফিতা বাঁধা, সাঁতার কাটতে শেখা, সাইকেল চালাতে পারা ইত্যাদি। তাকে সামাজিক শিষ্টাচার, খাওয়ার আদব, নিজের খেলনা ও বইপত্র গুছিয়ে রাখা, রাস্তা পার হওয়া, বাজার করাসহ নানাবিধ বাস্তব জীবনে ব্যবহার্য কাজ আনন্দময় পরিবেশে হাতে-কলমে শেখানো হয়। সব স্কুলে বইয়ের লাইব্রেরির পাশাপাশি খেলনার লাইব্রেরি থাকে; সবাইকে বিভিন্ন খেলায় অংশগ্রহণ করতে হয়। স্কুল থেকে বাচ্চাদের গাছের বীজ সরবরাহ করা হয়, যাতে সে বাসায় বীজটা বপন করে অঙ্কুরোদগম থেকে শুরু করে চারা হওয়া পর্যন্ত প্রতিটা পর্ব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারে; প্রকৃতির সঙ্গে গড়ে তুলতে পারে নির্ভেজাল সখ্য। বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য স্কুলে ধুলাবালু মাখার জন্যও একটা দিন নির্ধারিত থাকে। সুস্থ জীবনধারার জন্য প্রয়োজনীয় নানা বিষয়ে তারা শিক্ষার্থীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ করে দেয়; প্রায়ই স্কুলের বাইরের বাস্তব জগতে নিয়ে যাওয়া হয়।
অভিভাবকদের মধ্যে যেন স্কুলের প্রতি মমতা ও দায়বদ্ধতা তৈরি হয়, এ জন্য জাপান ও নেদারল্যান্ডসে স্কুলের বিশেষ কিছু কাজে অংশগ্রহণের জন্য অভিভাবকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। যেমন বাচ্চাদের রাস্তায় নামিয়ে ট্রাফিক নিয়মকানুন শেখানোর দিনে, ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিনে বা স্কুলের বাগান পরিচর্যার দিনে অভিভাবকেরা আমন্ত্রিত হয়ে বিভিন্ন কাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন।

বাচ্চারা যেন আত্মকেন্দ্রিক না হয়, সে জন্য নেদারল্যান্ডসে বাসা থেকে আনা ফলমূল একসঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ার চল রয়েছে। জাপান ও নেদারল্যান্ডসের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী পাঠকেরা ‘তিন ভুবনের শিক্ষা’ বইটা একটু পড়ে দেখতে পারেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ইউটিউবেও প্রচুর তথ্য রয়েছে।
শিক্ষাকে আনন্দময় করে উপস্থাপন করা যেকোনো উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আমাদের দেশে শিশুরা স্কুলে যেতে ভয় পায় অথচ জাপান, নেদারল্যান্ডস বা ফিনল্যান্ডের শিশুরা বাসায় থাকার চেয়ে স্কুলে যেতেই বেশি ভালোবাসে।

আমরা যেসব গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছি তার বড় অংশই চাকরি পাচ্ছে না। ২০২০ সালে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কয়েক লাখ ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডবাসী চাকরি করছেন। যে দেশে জনসংখ্যার ঘাটতি থাকে, তারা জনবল আমদানি করতেই পারে। কিন্তু জনসংখ্যায় ভরপুর বাংলাদেশ কেন সেটা করে?

এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে যত্ন ও পরিকল্পনা নিয়ে ঢেলে সাজাতে হবে। সিলেবাস পরিমার্জনের আগে চাহিদা নিরূপণ করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘শিক্ষার হেরফের’ নিবন্ধে বলেন, ‘ছেলে যদি মানুষ করিতে চাই, তবে ছেলেবেলা হইতেই তাহাকে মানুষ করিতে আরম্ভ করিতে হইবে, নতুবা সে ছেলেই থাকিবে, মানুষ হইবে না।’

কিন্তু এই ছেলেমেয়েদর যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত পাঠ্যক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্বটি যাঁদের, তাঁরা এটা বিশ্বাসও করেন না যে সরকারি স্কুলে লেখাপড়া করানো যায়, তাদের ছেলেমেয়েরা বিদেশি কারিকুলামে বেসরকারি স্কুলে পড়ে ইউরোপ–আমেরিকায় থিতু হওয়ার স্বপ্ন দেখে। ফলে অবহেলিত থেকে যায় আমজনতার শিক্ষাব্যবস্থা।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড বা জাপানের চাহিদা, সংকট, সম্ভাবনা, সামর্থ্য ও প্রেক্ষাপট আমাদের থেকে আলাদা। ফলে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখানে হুবহু অনুসরণ করার কথা বলছি না; তার প্রয়োজনও নেই। তবে অবশ্যই ওসব দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক পরীক্ষিত ভালো বিষয় আছে, যা আমরা গ্রহণ করতে পারি।
শিক্ষা কোনো স্থবির বিষয় নয়; সময়ের আবর্তে সৃষ্ট নানামুখী নতুন চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এটা সব সময় গতিশীল-পরিবর্তনশীল। প্রতিনিয়ত চাহিদা নিরূপণ ও শিক্ষাব্যবস্থা হালনাগাদ করতে না পারলে সেই শিক্ষা অচল হতে বাধ্য।

প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকতে হলে, আমাদের বিপুলসংখ্যক সুনাগরিক দরকার, যারা সঠিকভাবে তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও পেশাদারি জীবন চালাতে পারবে। বিপুলসংখ্যক সুনাগরিক তৈরির এ কাজ বিচ্ছিন্নভাবে দু-একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান করতে পারবে না। এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপক ও সর্বজনীন রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ।
* লেখক: মো. মুনিবুর রহমান, সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়