পরীক্ষা বাদ, ভিন্ন আঙ্গিকে মূল্যায়নে পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি
পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নিয়ে আবারও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত জুনে সিদ্ধান্ত হয়, চলতি বছরও বৃত্তি পরীক্ষা হবে। কিন্তু এখন নতুন সিদ্ধান্ত হলো, প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা আর থাকছে না। তবে ‘ভিন্ন আঙ্গিকে’ মূল্যায়ন করে শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে এ তথ্য জানিয়েছেন। বৈঠকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন ছাড়াও শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি উপস্থিত ছিলেন।
‘ভিন্ন আঙ্গিকে’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে, সেটি এখনো ঠিক হয়নি। এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, বিশেষজ্ঞদের দিয়ে কমিটি করে দেওয়া হবে। তাঁরা আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক করবেন কী পদ্ধতি বা মূল্যায়নে বৃত্তি দেওয়া যায়।
আশা করব, এ পরীক্ষা নিয়ে আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে না। এখন নতুন শিক্ষাক্রম ও জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে মূল্যায়নের কাজটি করলে ভালো হবে। তবে এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে।
তবে ‘ভিন্ন আঙ্গিকে’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে, সেটি এখনো ঠিক হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, বিশেষজ্ঞদের দিয়ে কমিটি করে দেওয়া হবে। তাঁরা বসে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক করবেন কী পদ্ধতি বা মূল্যায়নে বৃত্তি দেওয়া যায়। তারপর সেটি অনুমোদন করা হবে।
এ বিষয়ে বৈঠকে উপস্থিত শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি সুনির্দিষ্ট করে না বললেও কিছুটা ধারণা দিয়েছেন। গতকাল সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এটি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত। মেধাবৃত্তি দীর্ঘকাল ধরে ছিল। মাঝে সেটি বন্ধ হয়েছিল।
এতে (বৃত্তি পরীক্ষা) মেধাবী ও অমেধাবী—এ রকম একটি বিভাজন হয়ে যায়। যেটি নতুন শিক্ষাক্রমের দর্শনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটি দিয়ে কিছু শিক্ষার্থী অনুপ্রাণিত হয়। বাকিরা অনুপ্রাণিত হওয়ার ঠিক উল্টোটা হয়। সে কারণে বৃত্তি থাকছে না। কিন্তু যারা ভালো করবে, যেকোনো বিষয়ে দক্ষতা দেখাবে, নানা রকম মেধার স্বাক্ষর রাখবে, তাদের নানাভাবে পুরস্কৃত করা সম্ভব।
একসময় বিদ্যালয়ের বাছাই করা শিক্ষার্থীদের নিয়ে হতো প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা। সেটি বাদ দিয়ে ২০০৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য শুরু হয় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা। এতে সব শিক্ষার্থীই বৃত্তি পাওয়ার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারত। যদিও পিইসি পরীক্ষা নিয়ে ছিল সমালোচনা। করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি এবং নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা বিবেচনায় নিয়ে তিন বছর ধরে পিইসি পরীক্ষা হয়নি।
এর মধ্যে চলতি শিক্ষাবর্ষ (গত জানুয়ারি থেকে) থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে চালু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য শ্রেণিতেও তা বাস্তবায়ন করা হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাথমিক বৃত্তির মতো পরীক্ষা নেওয়ার কথা নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ইতিমধ্যে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট পরীক্ষার পাশাপাশি অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা বাদ দিয়েছে।
কিন্তু গত বছরের একেবারে শেষ বেলায় এসে আকস্মিকভাবে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। যদিও বিশেষজ্ঞরা সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে।
পরীক্ষাও নেওয়া হয় গত বছর। এরপর ওই বৃত্তি পরীক্ষার ফল নিয়েও ব্যাপক ভুলভ্রান্তির ঘটনা ঘটে। সংবাদ সম্মেলন করে বৃত্তি পরীক্ষার ফল ঘোষণার পর ‘কারিগরি ত্রুটির’ কারণ দেখিয়ে ফল স্থগিত করতে হয়েছিল। পরে অবশ্য সংশোধন করে ফল প্রকাশ করা হয়।
এসব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই এ বছরও প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে গত ১১ জুন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে চিঠি দেওয়া হয়েছিল।
তাতে বলা হয়, ‘প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণি পাঠ্যক্রমে আরও মনোযোগী করতে এবং শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে এ পরীক্ষা নেওয়ার অনুরোধ করা হলো।’ কিন্তু এখন হঠাৎ করে সেই পরীক্ষা থেকে সরে এল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এই পরীক্ষা নিয়ে বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, বারবার পরিবর্তন হচ্ছে না। করোনার কারণে বন্ধ ছিল। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা বাদ হয়ে যাওয়ায় গত বছর এটি চালু করা হয়েছিল। সেটিও ছিল পাইলটিং (পরীক্ষামূলক)।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষাবিদেরা এই পরীক্ষা বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এই পরীক্ষা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তে সাধুবাদ জানাই। আশা করব, এই পরীক্ষা নিয়ে আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে না। এখন নতুন শিক্ষাক্রম ও জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে মূল্যায়নের কাজটি করলে ভালো হবে। তবে এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। এসব কাজের জন্য প্রয়োজনভিত্তিক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।’