শিক্ষাবর্ষের ৬ মাসেও ঠিক হয়নি মূল্যায়ন কাঠামো
শিক্ষাবর্ষের ছয় মাস শেষ হতে চললেও নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী এখনো পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়ন কাঠামো চূড়ান্ত করতে পারেনি শিক্ষা বিভাগ। উপরন্তু একের পর এক নতুন বিষয় সামনে আসছে। অথচ এই মূল্যায়ন কাঠামোর আদলে আগামী মাসে শুরু হওয়া ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির ষাণ্মাসিক (অর্ধবার্ষিক) সামষ্টিক মূল্যায়ন, পরীক্ষামূলকভাবে নবম শ্রেণির বার্ষিক মূল্যায়ন কেন্দ্রভিত্তিক নেওয়াসহ কিছু কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা করেছিল জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
মূল্যায়ন কাঠামো চূড়ান্ত না হওয়ায় পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়টি অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। এ ছাড়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও রয়েছে বিভ্রান্তির মধ্যে। তাই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরামর্শ হলো, দ্রুত সময়ের মধ্যে মূল্যায়ন কাঠামো চূড়ান্ত করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানিয়ে দেওয়া উচিত।
অবশ্য এনসিটিবির চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান আশা প্রকাশ করে বলেন, সবকিছু মোটামুটি ঠিক করা হয়েছে। এখন জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) সভায় অনুমোদিত হলেই সেটি সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হবে।
শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে; কিন্তু মূল্যায়নটি কেমন করে হবে তা ঠিক না হওয়া কাম্য নয়। তাই মূল্যায়ন কাঠামো অবশ্যই দ্রুত চূড়ান্ত করা উচিত।অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান, আইইআর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দেশে গত বছর নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়। বর্তমানে প্রাথমিকে প্রথম থেকে তৃতীয় এবং ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রমে অধ্যয়ন করছে। বর্তমানে যারা নবম শ্রেণিতে পড়ছে, তারাই নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। পর্যায়ক্রমে ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে চালু হবে নতুন শিক্ষাক্রম।
শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত সূত্রগুলো বলছে, নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন কাঠামো চূড়ান্ত করতে এখন মূলত শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করছে। এনসিটিবি গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে-বিদেশের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার আলোকে মূল্যায়নের খসড়া প্রণয়ন করেছিল। সেটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়েও উপস্থাপন করা হয়েছিল। একপর্যায়ে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন–পদ্ধতি চূড়ান্তকরণের কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে। তারাও সুপারিশ দিয়েছে। সেই সুপারিশের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়ের আরেকটি সভায় সেটি আবারও সংশোধন করা হয়। আনুষঙ্গিক কাজ শেষে এনসিটিবির বোর্ড সভায় সেটি অনুমোদন দেওয়া হয়। তারপর সেটি এনসিসিসির সভায় উপস্থাপনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর বিষয়টি আটকে আছে। উল্লেখ্য, এনসিসিসি মন্ত্রণালয় পর্যায়ের একটি কমিটি, যেখানে শিক্ষাক্রমের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়ন কেমন হবে, তা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে একের পর এক আলোচনা হচ্ছে। এসব আলোচনায় উঠে আসছে নতুন নতুন প্রস্তাব। তাতে আগের প্রস্তাব পরিবর্তন হচ্ছে।
শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযানের উদ্যোগে গত ১১ জুন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের পাশাপাশি এক শিক্ষক বক্তব্য দিয়েছিলেন। তাঁর মূল কথা ছিল মূল্যায়নের বিষয়ে তাঁরা এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়ন কেমন হবে, তা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে একের পর এক আলোচনা হচ্ছে। এসব আলোচনায় উঠে আসছে নতুন নতুন প্রস্তাব। তাতে আগের প্রস্তাব পরিবর্তন হচ্ছে। যেমন সম্প্রতি নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নপদ্ধতি চূড়ান্তকরণ কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি যে চূড়ান্ত সুপারিশ করেছিল, তাতে এসএসসি পরীক্ষায় কার্যক্রমভিত্তিক অর্থাৎ হাতে-কলমে মূল্যায়নের ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ আর লিখিত অংশের ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ করতে বলেছিল; কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আরেকটি সভায় সেই প্রস্তাবও সংশোধন করা হয়। এতে এসএসসি পরীক্ষার সামষ্টিক মূল্যায়নের লিখিত অংশের ওয়েটেজ হতে যাচ্ছে ৬৫ শতাংশ। আর কার্যক্রমভিত্তিক অংশের ওয়েটেজ হবে ৩৫ শতাংশ।
মূল্যায়ন তথ্য সংরক্ষণের জন্য ‘নৈপুণ্য’ নামে অ্যাপ চালু করা হয়েছে; কিন্তু পাবলিক পরীক্ষার জন্য সেটি যুগোপযোগী করতে হবে; কিন্তু সেই কাজও থেমে আছে।
পরিকল্পনা ও বাস্তব চিত্র
নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত সূত্রগুলো বলছে, মূল্যায়ন কাঠামো বাস্তবায়নে কয়েকটি ধাপ ঠিক করা হয়েছে। প্রথম ধাপে পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়নের আদলে চলতি বছরের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ষাণ্মাসিক (অর্ধবার্ষিক) সামষ্টিক মূল্যায়ন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিচালনা করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। আগামী ৩ জুলাই থেকে শুরু হচ্ছে এই অর্ধবার্ষিক মূল্যায়ন; কিন্তু এখনো পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়ন কাঠামো চূড়ান্ত হয়নি। ফলে অর্ধবার্ষিক মূল্যায়ন পাবলিক পরীক্ষার আদলে নেওয়া অনিশ্চয়তায় মধ্যে পড়েছে।
এরপর এ বছরের শেষে নবম শ্রেণির বার্ষিক মূল্যায়নও একইভাবে নেওয়ার পরিকল্পনা আছে। ওই সময় কিছু এলাকায় পাইলটিং হিসেবে এসএসসি পরীক্ষার আদলে কেন্দ্রভিত্তিক মূল্যায়নের পরিকল্পনা আছে। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা প্রায় ছয় মাস পড়াশোনা শেষ করলেও তারা সুনির্দিষ্টভাবে জানে না মূল্যায়নটি কেমন হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আরেকটি সভায় সেই প্রস্তাবও সংশোধন করা হয়। এতে এসএসসি পরীক্ষার সামষ্টিক মূল্যায়নের লিখিত অংশের ওয়েটেজ হতে যাচ্ছে ৬৫ শতাংশ। আর কার্যক্রমভিত্তিক অংশের ওয়েটেজ হবে ৩৫ শতাংশ।
পরিকল্পনায় আছে আগামী বছর দশম শ্রেণির অর্ধবার্ষিক মূল্যায়ন পাবলিক পরীক্ষার মতো কেন্দ্রভিত্তিক হবে। তার আগে এই মূল্যায়ন কাঠামো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিষয়ভিত্তিক ‘রিসোর্স পুল’ গঠন করার কথা; কিন্তু এসবের কিছুই হয়নি।
মূল্যায়ন তথ্য সংরক্ষণের জন্য ‘নৈপুণ্য’ নামে অ্যাপ চালু করা হয়েছে; কিন্তু পাবলিক পরীক্ষার জন্য সেটি যুগোপযোগী করতে হবে; কিন্তু সেই কাজও থেমে আছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান মূল্যায়ন কাঠামো চূড়ান্ত করতে এত দেরি করা কোনোভাবেই ঠিক হচ্ছে না; কারণ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে; কিন্তু মূল্যায়নটি কেমন করে হবে তা ঠিক না হওয়া কাম্য নয়। তাই মূল্যায়ন কাঠামো অবশ্যই দ্রুত চূড়ান্ত করা উচিত।