চীনে ১ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থী দিলেন ‘সবচেয়ে কঠিনতম’ পরীক্ষা
চীনে উচ্চবিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে শিক্ষার্থীরা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এ পরীক্ষাকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন’ পরীক্ষাও বলা হয়। এ পরীক্ষার কেতাবি নাম ‘কাওখাও’। এবার ১ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ নিলেন।
কাওখাও চীনা শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। কারণ, ৬ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত একটানা ১২ বছর পড়াশোনা শেষে একটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষা অংশ নেওয়ার আগে প্রস্তুতিমূলক নানা পরীক্ষায় অংশ নেন শিক্ষার্থীরা। এ পরীক্ষার ফলাফলের স্কোরের ওপরই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ মেলে। ‘কাওখাও’ পরীক্ষার মাধ্যমে কোনো শিক্ষার্থী কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবেন, তা নির্ধারণ হয়। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের জীবন ও কর্মসংস্থান অনেকাংশে নির্ভর করে এ পরীক্ষার ফলের ওপর।
এ পরীক্ষায় অংশ নিতে পড়াশোনার জন্য ৪ বছর ধরে রোববার ছাড়া প্রতিদিন ভোর ৪টায় ঘুম থেকে উঠতাম। আমার পক্ষে যা যা করার, তা করেছি
শিক্ষার্থীদের চীনা, ইংরেজি, গণিত ও তাঁদের পছন্দের বিজ্ঞান বা মানবিক বিষয়ের ওপর পরীক্ষা নেওয়া হয়—চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হওয়ার জন্য। এ পরীক্ষা ৭৫০ স্কোরের। চীনের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তিতে ৬০০–এর বেশি নম্বর দরকার হয়।
চীনের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে এ পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শূন্য-কোভিড নীতি তুলে নেওয়ার পর দেশটির লাখো শিক্ষার্থী সম্প্রতি এ কঠিন পরীক্ষা দিলেন। এ পরীক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের কয়েক মাসের অনলাইনে ক্লাস শেষ হলো। অনলাইন ক্লাস ছিল বাধ্যতামূলক।
৭ থেকে ১০ জুন পর্যন্ত সারা দেশের ৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থী কঠিনতম এ পরীক্ষায় অংশ নেন। চার দিনের এসব পরীক্ষা এক ঘণ্টা থেকে আড়াই ঘণ্টা পর্যন্ত দিতে হয় শিক্ষার্থীদের।
চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, এ বছর প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থী ‘গাওকাও’ পরীক্ষা দেওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছে। চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম এ পরীক্ষাকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন’ পরীক্ষা বলে ঘোষণা করেছে।
জেসে রাও পড়ে শেনজেনের উচ্চবিদ্যালয়ে। ১৭ বছর বয়সী জেসে রাও পরীক্ষার আগে বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলে, ‘এ পরীক্ষায় অংশ নিতে পড়াশোনার জন্য চার বছর ধরে রোববার ছাড়া প্রতিদিন ভোর ৪টায় ঘুম থেকে উঠতাম। আমার পক্ষে যা যা করার, তা করেছি। কিন্তু আমি এখনো কিছুটা ঘাবড়ে গেছি।’
দেশটির ঐতিহ্যবাহী পোশাক লাল কিপাও পরে পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে অপেক্ষা করছেন ঝাং। তিনি এএফপিকে বলেন, ‘আমার ছেলে বেশ স্বাভাবিকই আছে। আমার মনে হচ্ছে আমিই তার চেয়ে বেশি নার্ভাস। তিনি বলছিলেন, আমি ছেলের সঙ্গে এসেছি। তাঁকে পড়াশোনার জন্য শুরু থেকে নির্দেশনা দিয়েছি।’
আরেক মা ফ্যাং হং এএফপিকে বলেন, ‘তিনি ছেলের জন্য রুটি ও ডিমের তৈরি নাশতা তৈরি করে এনেছেন। আমার ছেলে কিছুটা নার্ভাস ছিল। আমি তাঁকে বলেছি, আমরা গাওকাওর যেকোনো ফল মেনে নেব। আমরা তাঁর ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করতে পারি না।’
শিক্ষার্থীদের চীনা, ইংরেজি, গণিত ও তাঁদের পছন্দের বিজ্ঞান বা মানবিক বিষয়ের ওপর পরীক্ষা নেওয়া হয়—চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হওয়ার জন্য। এ পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীরা বেশ চাপেই থাকেন। অভিভাবকদের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার খরচ করতে হয়। শিক্ষার্থীদের জন্য মক বা নানা প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষায়ও অর্থ ব্যয় হয়।
পড়াশোনার চাপের সঙ্গে গত বছরগুলোতে পরীক্ষার্থীরা করোনা মহামারি বিধিনিষেধের মধ্যে কাটিয়েছে। করোনা বিধিনিষেধ গত বছরের ডিসেম্বরে তুলে নেওয়া হয়। গত দুই বছর দুটি ধাপে লকডাউনের মধ্য দিয়ে যাওয়া সাংহাইয়ের উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী ক্যাথরিনা ওয়াং এএফপিকে বলে, ‘গত বছরে অনলাইন ক্লাসের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। শিক্ষকেরা সন্ধ্যায় ও সপ্তাহ শেষে আমাদের অতিরিক্ত ক্লাস নিয়েছেন।’
দেশটির সরকার নিয়ন্ত্রিত গ্লোবাল টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, করোনার কারণে শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষা দিতে পারেনি।
এ পরীক্ষা ৭৫০ স্কোরের। ভর্তির ক্ষেত্রে স্কোর গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। চীনের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তিতে ৬০০–এর বেশি নম্বর দরকার হয়। গত বছর, চীনের সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ গুয়াংডং-এ মাত্র ৩ শতাংশ পরীক্ষার্থী ৬০০–এর বেশি স্কোর পেয়েছিল। কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না হলে এ পরীক্ষা আবার পরের বছর দেওয়া যায়। ২০২১ সালে ১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী আবারও গাওকাও পরীক্ষা দিয়েছিল।
চীন প্রতিষ্ঠার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদাভাবে শিক্ষার্থীদের ভর্তি-পরীক্ষার নিয়ম ছিল। ১৯৫২ সালে প্রথম ‘গাওকাও’ পরীক্ষা চালু হয়। সে সময় প্রতিবছরের ১৫ থেকে ১৭ আগস্ট এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো। তখন অবশ্য এ পরীক্ষা বলা হতো অভিজাত শ্রেণিদের জন্য পরীক্ষা। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত এ পরীক্ষা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৭৭ সালের অক্টোবরে এ পরীক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার করে আবার শুরু হয়। এরপর থেকে কোটি কোটি চীনা শিক্ষার্থীর ভাগ্য পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে ‘গাওকাও’। গত বছরে ২০২২ সালে ১ কোটি ১০ লাখ পরীক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ নেয়। ২০ লাখ বেড়ে এ বছর পরীক্ষার্থী ১ কোটি ৩০ লাখ হয়েছে। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির জন্য আসন আছে প্রায় এক কোটি।
পরীক্ষা শেষে ফলাফল প্রকাশিত হলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ফলাফল জেনে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে পারবেন।