বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন ‘গাওকাও’ পরীক্ষা দিলেন ১ কোটি ৩৪ লাখ ২০ হাজার শিক্ষার্থী
চীনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষার নাম ‘গাওকাও’। এ পরীক্ষা শুরু হয়েছে গত শুক্রবার। পরীক্ষার প্রথম দিন চীনের একটি পরীক্ষাকেন্দ্রের বাইরে লাল রঙের পোশাকে মা ও বাবা ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। বেইজিংয়ের পরীক্ষাকেন্দ্রে সন্তান প্রবেশ করেছেন আর অপেক্ষায় বাবা-মায়েরা। এ চিত্র প্রায় প্রতিবছরই গণমাধ্যমে আসে। এটি আসার কারণে হলো দেশটির সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হলো এই ‘গাওকাও’। এ পরীক্ষায় নির্ধারিত হয় অনেক শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ।
চীনের দুই দিনব্যাপী এই জাতীয় কলেজ ভর্তি পরীক্ষা পৃথিবীর বৃহত্তম একাডেমিক পরীক্ষা হিসেবে পরিচিত। চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম এ কে ‘বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন’ কলেজ ভর্তি পরীক্ষা বলেও আখ্যা দিয়েছে। তীব্র প্রতিযোগিতা ও ঝুঁকির কারণে এ পরীক্ষাকে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা বলা হচ্ছে। ১২ বছরের শিক্ষাজীবনে শিক্ষার্থীরা যা যা শিখেছেন, তার সবকিছুর পরীক্ষা হয় মাত্র কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে। দুই ঘণ্টারও কম সময়ে শিক্ষার্থীরা এ পরীক্ষা দেন।
গত বছরের রেকর্ড ভেঙে এ বছর পরীক্ষার জন্য ১৩ দশমিক ৪২ মিলিয়নের বেশি শিক্ষার্থী নিবন্ধন করেছেন। চীনে এর আগে এত শিক্ষার্থী ‘গাওকাও’ পরীক্ষায় অংশ নেননি। গত বছর ১২ দশমিক ৯ মিলিয়ন শিক্ষার্থী এ পরীক্ষার জন্য নিবন্ধন করেছিলেন।
ঝি হাইডং নামের এক অভিভাবক দেশটির ঐতিহ্যবাহী লাল কিপাও পোশাক পরে মেয়েকে বেইজিংয়ের একটি পরীক্ষাকেন্দ্রে এসেছেন। ৫০ বছর বয়সী ঝি হাইডং এএফপিকে বলেছেন, ‘লোকে বলে, এটি একটি জীবনের শুরু। তাই কেউ নমনীয় হয়ে বা শিথিল হতে পারে না।’
চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ধীরে হয়ে যাওয়া এবং তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের ওপর এ পরীক্ষায় ভালো করার চাপ বেড়ে গেছে বহুগুণ। এ ব্যাপারে ঝি হাইডং বলেন, ‘আমার মনে হয়, এটি বেড়ে ওঠার একটি প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন কি না, তা-ও দেখা দরকার আছে। (গাওকাও) দেশের মেধাবীদের নির্বাচনের একটি পদ্ধতিমাত্র। চাপের মধ্যে পড়লেই আবার মানসিক সহনশীলতা বাড়তে পারে। এতে ভবিষ্যতে কাজ করার সময় আপনি চাপগুলো সহ্য করতে পারবেন। আমার মনে হয়, এটি সবার বোধগম্য বিষয়।’
শুক্রবার পরীক্ষার প্রথম দিনে পরীক্ষার হলের বাইরে ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মায়েদের উদ্বিগ্ন চেহারায় অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। অনেক মা-বাবা ও শিক্ষক লাল পোশাক পরেছিলেন। চীনে লাল বিজয়ের প্রতীক। আবার অনেকের হাতে ছিল সূর্যমুখী ফুল। একাডেমিক ক্ষেত্রে সফলতা পাওয়ার জন্য এই ফুলকে শুভ বলে ধরে নেওয়া হয়।
চীনে উচ্চবিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে শিক্ষার্থীরা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এ পরীক্ষাকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন’ পরীক্ষাও বলা হয়।
এ পরীক্ষা চীনা শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। কারণ, ৬ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত একটানা ১২ বছর পড়াশোনা শেষে একটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষা অংশ নেওয়ার আগে প্রস্তুতিমূলক নানা পরীক্ষায় অংশ নেন শিক্ষার্থীরা। এ পরীক্ষার ফলাফলের স্কোরের ওপরই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ মেলে। ‘গাওকাও’ পরীক্ষার মাধ্যমে কোনো শিক্ষার্থী কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবেন, তা নির্ধারণ হয়। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের জীবন ও কর্মসংস্থান অনেকাংশে নির্ভর করে এ পরীক্ষার ফলের ওপর।
পরীক্ষা কত স্কোরের
শিক্ষার্থীদের চীনা, ইংরেজি, গণিত ও তাঁদের পছন্দের বিজ্ঞান বা মানবিক বিষয়ের ওপর পরীক্ষা নেওয়া হয়—চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি হওয়ার জন্য। এ পরীক্ষা ৭৫০ স্কোরের। চীনের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তিতে ৬০০-এর বেশি নম্বর দরকার হয়। চীনের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পড়তে এ পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না হলে এ পরীক্ষা আবার পরের বছর দেওয়া যায়।
এ পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীরা বেশ চাপেই থাকেন। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার খরচ করতে হয় অভিভাবকদের। শিক্ষার্থীদের জন্য মক বা নানা প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষায়ও অর্থ ব্যয় হয়।
চীন প্রতিষ্ঠার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদাভাবে শিক্ষার্থীদের ভর্তি-পরীক্ষার নিয়ম ছিল। ১৯৫২ সালে প্রথম ‘গাওকাও’ পরীক্ষা চালু হয়। সে সময় প্রতিবছরের ১৫ থেকে ১৭ আগস্ট এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো। তখন অবশ্য এ পরীক্ষা বলা হতো অভিজাত শ্রেণিদের জন্য পরীক্ষা। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত এ পরীক্ষা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৭৭ সালের অক্টোবরে এ পরীক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার করে আবার শুরু হয়। এরপর থেকে কোটি কোটি চীনা শিক্ষার্থীর ভাগ্য পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে ‘গাওকাও’। গত বছরে ২০২২ সালে ১ কোটি ১০ লাখ পরীক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ নেয়। ২০ লাখ বেড়ে এ বছর পরীক্ষার্থী ১ কোটি ৩০ লাখ হয়েছে। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির জন্য আসন আছে প্রায় এক কোটি।
পরীক্ষা শেষে ফলাফল প্রকাশিত হলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ফলাফল জেনে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে পারবেন।