অর্ধবার্ষিক মূল্যায়নের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় প্রধান শিক্ষকদের মাধ্যমে, চিহ্নিত দুজন
বদলে যাওয়া নিয়মে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির ষাণ্মাসিক (অর্ধবার্ষিক) মূল্যায়নের শিক্ষার্থী নির্দেশিকা (প্রশ্নপত্র) ফাঁস হচ্ছে। এর মধ্যে দুই দিন মূল্যায়ন হয়েছে, কিন্তু দুই দিনই একাধিক শ্রেণির একাধিক বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। একাধিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের মাধ্যমেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। এ ঘটনায় জড়িত দুজন প্রধান শিক্ষককে চিহ্নিতও করেছে শিক্ষা বিভাগ। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এবার নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী নতুন পদ্ধতিতে, নতুন প্রশ্নপত্রে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই মূল্যায়ন কার্যক্রম। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) হিসাবে সারা দেশে এক কোটির মতো শিক্ষার্থী এই মূল্যায়ন কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে।
আজ বুধবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে তৃতীয় দিনের মূল্যায়ন। এই মূল্যায়নের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে গতকাল মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখানে শুধু সমাধান দেওয়ার মধ্যেই নম্বর দেওয়ার বিষয় নেই; বরং অনেক ক্ষেত্রে ওপেন বুক পরীক্ষার মতো। তারপরও মূল্যায়নের বিষয়টি যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, তাই চেষ্টা করা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে কাজটি না করে।’
‘প্রশ্নপত্রের সুরক্ষার জন্য এসএসসি ও এইচএসসির মতো ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।’এস এম হাফিজুর রহমান, অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
৩ জুলাই শুরু হওয়া এই মূল্যায়ন কার্যক্রমের প্রথম দিনেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। একাধিক অভিভাবক জানান, পরীক্ষার আগের দিন রাতে ও পরীক্ষার দিন সকালে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মূল্যায়ন কার্যক্রমের শিক্ষার্থী নির্দেশিকা বা প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ে। সঙ্গে উত্তর তৈরি করেও ছড়ানো হয়। পরে দেখা যায়, মূল্যায়ন কার্যক্রমের শিক্ষার্থী নির্দেশিকার সঙ্গে ফাঁস হওয়া নির্দেশিকার হুবহু মিল পাওয়া গেছে। এরপর ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় দিনের মূল্যায়নেও একাধিক বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, এবার মূল্যায়নে শিক্ষার্থী নির্দেশিকা বা প্রশ্নপত্র তৈরি করে তা পরীক্ষার আগের দিন সন্ধ্যায় নৈপুণ্য অ্যাপের (নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়নসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য এই অ্যাপে সংরক্ষণ করা হয়) মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের নিজস্ব আইডিতে পাঠানো হচ্ছে। পরে প্রতিষ্ঠানপ্রধানেরা নির্ধারিত পাসওয়ার্ড দিয়ে তা ডাউনলোডের পর ফটোকপি করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করছেন। অন্য কারও তাতে ঢোকার সুযোগ নেই।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, প্রথম দিন প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর নৈপুণ্য অ্যাপের ইউজার আইডির মাধ্যমে এই মূল্যায়ন নির্দেশনা ডাউনলোড ও বিতরণ কার্যক্রম ট্র্যাকিং করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হয়। এরপর কার আইডি থেকে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়, এটি চিহ্নিত করা হয়।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ও এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার আমিনাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের (ইআইআএন বা পরিচিতি নম্বর ১০১৩০২) প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে নৈপুণ্য অ্যাপের মাধ্যমে পাঠানো ষাণ্মাসিক মূল্যায়নের নবম শ্রেণির ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি’ বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয়েছে। অন্যদিকে একই দিনে অনুষ্ঠিত ‘শিল্প ও সংস্কৃতি’ বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় পটুয়াখালী সদর উপজেলার ডোনাভান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে।
মাউশি সূত্রে জানা গেছে, মূল্যায়নের পরদিন এ দুই প্রধান শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। দুজনই এমপিওভুক্ত শিক্ষক। তিন কর্মদিবসের মধ্যে তাঁদের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
এ দুই শিক্ষকের বেতন স্থগিত করা হতে পারে বলে জানান মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ।
এর আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের প্রতি জরুরি বার্তা পাঠায় এনসিটিবি। তাতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানপ্রধানের মাধ্যমে মূল্যায়ন কার্যক্রমের নির্দেশনাগুলো কোনো অপ্রাসঙ্গিক কমিউনিটি বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ারের বিষয়টি প্রমাণিত হলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ জন্য মূল্যায়ন নির্দেশনাগুলো বিতরণের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে আরও দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিষয় ও শ্রেণিভেদে বিরতি দিয়ে চার থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টায় হচ্ছে এ মূল্যায়ন। এবার হাতে–কলমে কাজ ও কার্যক্রমভিত্তিক লিখিত অংশের ভিত্তিতে হচ্ছে মূল্যায়ন। প্রশ্নের ধরনও একেবারে ভিন্ন।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেন, এই মূল্যায়ন নির্দেশিকাগুলো কোনো শিক্ষার্থী আগে থেকে জেনে গেলেও মূল্যায়ন কার্যক্রমে সমস্যা হবে না। কারণ, এগুলো মুখস্থ করে লেখার বিষয় নয়। কিন্তু অসুবিধাটি হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুল ও বিভ্রান্তিকর সমাধান দেওয়া হচ্ছে, যা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করছে। এ জন্য চেষ্টা হয়েছে যাতে এটি না হয়।
বিদ্যালয়ের অর্ধবার্ষিক মূল্যায়নের প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর এ বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাবের বিষয়টিও সামনে এসেছে। অবশ্য এবার এনসিটিবির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র তৈরি করে তা পাঠানো হলেও এরপর শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে তা করা হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বলা হচ্ছে, এই প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও মূল্যায়নে প্রভাব পড়বে না। কিন্তু তাঁর কাছে মনে হয়েছে, এ বিষয়ে অনেকেই আস্থা পাচ্ছে না। তাই এটি ভালো করে বোঝাতে হবে। এ ছাড়া প্রশ্নপত্রের সুরক্ষার জন্য এসএসসি ও এইচএসসির মতো ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।