প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার সংশোধিত ফল প্রকাশ, ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ
প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার সংশোধিত ফল প্রকাশ করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। আজ বুধবার রাত সাড়ে ১০টার পর এই ফল প্রকাশ করে আগের ফলে ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে তারা।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বৃত্তি পরীক্ষার ফল ঘোষণা করেছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। কিন্তু ‘কারিগরি ত্রুটির’ কারণ দেখিয়ে সন্ধ্যায় এ ফল স্থগিত করা হয়। পরে মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, ‘কারিগরি ত্রুটির’ কারণে স্থগিত প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফল সংশোধন করে আজ বুধবার বিকেলে প্রকাশ করা হবে। কিন্তু সন্ধ্যায় মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, স্থগিত ফলাফল আজ রাতের মধ্যে প্রকাশ করা হবে। কিন্তু রাতে কখন প্রকাশ হবে, তা উল্লেখ করা হয়নি। পরে রাত সাড়ে ১০টার পর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, স্থগিত করা ফলাফল পুনর্যাচাই করে প্রকাশ করা হলো।
কীভাবে ভুলটি হয়েছে, তার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, ফল তৈরির সঙ্গে যুক্ত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কারিগরি দলের গাফিলতির কারণেই এমন ভুলের ঘটনা ঘটেছে। আর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এ ‘দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ডের’ জন্য এখন হাজারো শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, তিন বছর ধরে না হওয়া প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ফলাফলের মতো করে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফল তৈরি করতে গিয়েই সমস্যাটি হয়েছে। ওই পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হতো উপজেলাভিত্তিক। বৃত্তি পরীক্ষার ফল তৈরিতেও উপজেলাভিত্তিক ডেটা নিয়ে কাজ করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্রের কোডের ক্ষেত্রে ভুল করা হয়েছে। এতে একাধিক উপজেলার কোড (কম্পিউটারের কাজের একটি ব্যবস্থা) একই হওয়ায় সমস্যাটি হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হয়তো ঝিনাইদহের একটি উপজেলার শিক্ষার্থীর যে কোড ছিল, তা হয়তো সুনামগঞ্জের কোনো উপজেলায়ও ছিল। কেন্দ্রীয়ভাবে ফল তৈরির জন্য ডেটা নিয়ে যখন কাজ করা হয়, তখন একই কোড হওয়ায় ফলেও ভুল হয়েছে। দুই কোড যখন এক হয়ে গেছে, তখন হয়তো যে শিক্ষার্থীর বৃত্তি পাওয়ার কথা নয়, সেও বৃত্তির তালিকাভুক্ত হয়ে গেছে, আবার উল্টোটাও ঘটেছে। এমনকি নিবন্ধন করে পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও কেউ কেউ বৃত্তি পেয়ে গেছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বৃত্তি পরীক্ষার ফল প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট (www.dpe.gov.bd) এবং মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট (www.mopme.gov.bd), স্থানীয়ভাবে বিভাগীয় উপপরিচালকের কার্যালয়, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার এবং উপজেলা বা থানা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে পাওয়া যাবে। ঘরে বসেও মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়ে ফল জানা যাবে। এ জন্য মোবাইলে DPE Thana/Upazila Code No.Roll Number Year লিখে 16222–এ এ পাঠালে ফিরতি এসএমএসে ফল জানিয়ে দেওয়া হবে।
যেমন বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার পাঁচপাইকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছিল এক শিক্ষার্থী। কিন্তু সে পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। কিন্তু তাকেও বৃত্তি (সাধারণ কোটা) পাওয়ার তালিকায় রাখা হয়েছে। এ রকম ঘটনা আরও ঘটেছে।
এবার পাঁচ লাখের বেশি শিক্ষার্থী পরীক্ষার জন্য নিবন্ধন করেছিল। অবশ্য পরীক্ষায় অংশ নেয় ৪ লাখ ৮২ হাজার ৯০৪ শিক্ষার্থী।
প্রাথমিক বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীরা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতি মাসে নির্ধারিত পরিমাণে টাকা পায়। এর মধ্যে মেধা কোটায় (ট্যালেন্টপুল) বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীরা মাসে ৩০০ টাকা এবং সাধারণ কোটায় শিক্ষার্থীরা মাসে ২২৫ টাকা করে পাবে। এ ছাড়া বৃত্তি পাওয়া সব শিক্ষার্থী বছরে এককালীন ২২৫ টাকা করে পায়। বৃত্তির মোট কোটা হলো ৮২ হাজার ৫০০টি। অবশ্য গতকাল সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, ২০২২ সালের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় মোট ৮২ হাজার ৩৮৩ শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে। এর মধ্যে মেধা কোটায় (ট্যালেন্টপুল) বৃত্তি পেয়েছে ৩৩ হাজার ও সাধারণ কোটায় ৪৯ হাজার ৩৮৩ শিক্ষার্থী। এখন সংশোধিত ফলের পর সংখ্যাটি কত হয়, সেটি জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ভুলের সংখ্যাটি একেবারে কমও হবে না। এখন ফল সংশোধন করা হচ্ছে। আজকের মধ্যেই সংশোধিত ফল প্রকাশের কথা রয়েছে। তিনি বলেন, কারিগরি দলের ভুল ছিল বলে মনে হয়েছে। কারিগরি দলের কেউ কেউ তা স্বীকারও করেছেন।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সূত্রমতে, বাদ হওয়া ফলাফলে বৃত্তি পাওয়া কেউ কেউ সংশোধিত ফলাফলে বাদ যেতে পারে।
এদিকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক উত্তম কুমার দাশ প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, এ ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রশাসনিক একজন কর্মকর্তার পাশাপাশি কারিগরি অভিজ্ঞতা থাকা আরও দুজন কর্মকর্তা নিয়ে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ, পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নিয়ে শুরু থেকে ফল প্রকাশ পর্যন্ত গাফিলতি ও ‘একরোখা’ ভূমিকার পরিচয় দিয়েছে সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ। শিক্ষাবিদদের পরামর্শ উপেক্ষা করে গত বছরের শেষ সময়ে আকস্মিক ঘোষণা দিয়ে এ পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। আর গতকাল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর সন্ধ্যায় তা স্থগিত করা হলো, যা নিয়ে এখন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
করোনার সংক্রমণ ও নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে গত তিন বছর পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। এ পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতেই শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া হতো। যদিও ২০০৯ সালের আগে পৃথকভাবে বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়া হতো। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে আর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নেওয়া হবে না—এমনটা বলে আসছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকেরা। কিন্তু হঠাৎ গত ২৮ নভেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক আন্তমন্ত্রণালয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ২০২২ সালের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা হবে। তখন ওই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিলেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সুলতানা কামাল, রাশেদা কে চৌধূরী, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, মনজুর আহমদসহ দেশের ২৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক। তাঁরা বলেছিলেন, এই বৃত্তি পরীক্ষার কার্যক্রমে বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর মাধ্যমে কোচিং-বাণিজ্য ও গাইড বইয়ের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধিরও আশঙ্কা রয়েছে। তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে।
প্রথমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল বৃত্তি পরীক্ষা হবে ২৯ ডিসেম্বর (২০২২ সাল) এবং ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী (সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয় ঠিক করবে) তাতে অংশ নিতে পারবে। কিন্তু পরে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পরীক্ষা নেওয়া হয় ৩০ ডিসেম্বর। আর পরীক্ষা দিতে পেরেছে একেকটি বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিপড়ুয়া ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী। বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতিটিতে ২৫ নম্বর করে মোট ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে এ পরীক্ষা হয়।