৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় একটি খবর চোখে পড়ল—বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সমাবর্তন ১৯ মার্চ, শিগগিরই নিবন্ধন শুরু হবে। সত্যিই? খবরটা যাচাই করতে বুয়েটের ওয়েবসাইটে ঢুকলাম, যদিও সাইটে ঢুকতে বেশ খানিকটা বেগ পেতে হলো। সম্ভবত আমার মতো অনেকেই তখন খবরের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চেষ্টা করছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানলাম, খবরটা সত্যি! সমাবর্তন যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক অনুষঙ্গ। কিন্তু সেটার জন্য আমাদের কেন এত রোমাঞ্চ, তার কারণটা বলি। বুয়েট থেকে স্নাতক শেষ করেছি দুই বছর আগে। এতকাল কোনো সমাবর্তন প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়নি। পাস করার পরপর অপেক্ষায় দিন গুনছিলাম, কবে কালো গাউন পরে নিজের ক্যাম্পাসে পা রাখার সুযোগ হবে! আমার মতোই অপেক্ষায় দিন গুনছিল আগে-পরের আরও বেশ কয়েকটি ব্যাচ।
বলা হয়েছিল, ১ জানুয়ারি ২০১১ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮–এর মধ্যে পাস করা ছাত্রছাত্রী এবং গবেষকদের স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং অন্যান্য ডিগ্রি দেওয়া হবে। সে হিসাবে বুয়েটের নয়টি শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করবেন। এক স্নাতক ডিগ্রি পাওয়া শিক্ষার্থী সংখ্যাই ৭ হাজার ৯৯২। বোঝা যাচ্ছিল, এর আগের ১০টি সমাবর্তনের
তুলনায় নিঃসন্দেহে এবারের সমাবর্তন বড় আকারের।
২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলছিল নিবন্ধন। এর মধ্যে সিনিয়র-জুনিয়র যার সঙ্গেই দেখা হয়েছে, সবার একই কথা। ‘সমাবর্তনে যাচ্ছ/যাচ্ছেন তো?’ অনেক বন্ধু-বড় ভাইবোন উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে আছেন। মেসেঞ্জারের কল্যাণে তাঁদেরও টোকা দিই, ‘আসবেন নাকি?’ যা হোক, বুয়েটের ওয়েবসাইটে দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত ১১তম সমাবর্তনে অংশগ্রহণের জন্য নাম নিবন্ধন করেন ৫ হাজার ২৮৪ জন স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী।
নাম নিবন্ধনের পর আমরা অপেক্ষায় ছিলাম, কখন গাউন হাতে পাব। মুশকিল হলো, সমাবর্তন মানেই সবার চোখে ভাসে বাতাসে হ্যাট উড়িয়ে দেওয়ার ছবি। কিন্তু বুয়েটের সমাবর্তনে হ্যাট পরার রীতি নেই। অগত্যা কী আর করা, অনুষ্ঠানের দিন নাহয় রীতি মেনেই হাজির হলাম, কিন্তু আগের দিন হ্যাট পরে ছবি তুলতে তো বাধা নেই। অনলাইনে অর্ডার করে অনেকে হ্যাট জোগাড় করে ফেললেন। রেজিস্ট্রার ভবনের নিচে সমাবর্তনের টুপি বিক্রির ছোটখাটো ব্যবস্থাও চোখে পড়ল।
উৎসবমুখর একটা আমেজ টের পাওয়া যাচ্ছিল গাউন বিতরণের দিন থেকেই। সেই আমেজ পুরোপুরি প্রাণ পেল ১৮ ও ১৯ মার্চ। ১৮ মার্চ সমাবর্তনের মহড়া, পরদিন মূল অনুষ্ঠান। পলাশীর মোড় থেকে শুরু করে পুরো ক্যাম্পাস, ঠিক যেন হ্যারি পটারের গল্পের ছোট্ট একটা ‘হগওয়ার্টস’। হাজার হাজার জাদুকর শিক্ষার্থী, জায়গায় জায়গায় দল বেঁধে, কেউ বা একা একা ছবি তুলছিলেন। এই ক্যাম্পাসে, এমন একটা ছবির স্বপ্ন কেউ কেউ হয়তো দেখেছেন একদম ছোট্টবেলা থেকে। অবশেষে স্বপ্ন পূরণ হলো!
মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় বুয়েটের আচার্য, বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদসহ শিক্ষকদের প্যারেড করে অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশের মাধ্যমে। এর আগেই সব শিক্ষার্থী সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে মাঠে ঢুকে প্রতিটি বিভাগের জন্য পূর্বনির্ধারিত আসনে জায়গা করে নেন। বুয়েটের মাঠটা অনেক বড়, অনেক বেশি সুন্দর; কিন্তু হাজার পাঁচেক শিক্ষার্থী এবং উপস্থিত অতিথিদের পদচারণে সেই মাঠটাও মনে হলো অনেক ছোট। সেদিন মোবাইল বা ক্যামেরা আনার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু দৃশ্যটা নিশ্চয়ই প্রত্যেকের মনে ‘সেভ’ করা আছে।
এক শামিয়ানার নিচে এতজন স্নাতক, গবেষকদের কাতারে থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্তির মুহূর্তটি নিঃসন্দেহে আমার বা আমাদের জীবনের বড় প্রাপ্তি। বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার পর যখন সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি, মনে হলো সমাবর্তনের আদলে এটি একটি পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানও। মূল সনদ সংগ্রহ করতে হবে ৬ থেকে ১৭ এপ্রিলের মধ্যে। এরই মধ্য দিয়ে প্রিয় এই ক্যাম্পাসের সঙ্গে শেষ হবে সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা—ভাবতেই একটু কেমন-কেমন লাগে!
লেখক: ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে পুরকৌশল বিভাগ থেকে স্নাতক