২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ইউজিসি অনেক সুপারিশ দেয়, অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয় না

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)
ফাইল ছবি

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুর কমিশন (ইউজিসি) প্রতিবছরই তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে সরকারের কাছে অনেক সুপারিশ করে। কিন্তু এই সুপারিশের অধিকাংশই বাস্তবায়ন করা হয় না। তবু ইউজিসি গৎবাঁধাভাবে এসব সুপারিশ করে।

তবে ইউজিসির কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয় মূলত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের সঙ্গে মিল পড়ে যাওয়ায়। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গুচ্ছভিত্তিক বা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া। তবে এই সুপারিশও এখনো সব বিশ্ববিদ্যালয় মানেনি।

গত ৩০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য মো. আবদুল হামিদের কাছে ৪৭তম বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দেয় ইউজিসি। এই প্রতিবেদনে ইউজিসি সুপারিশ করে বলে, সন্ধ্যাকালীন, উইকএন্ড, এক্সিকিউটিভ ইত্যাদি কোর্স পরিচালনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। এ জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলা এসব কোর্স বন্ধ হওয়া জরুরি। গতবারের বার্ষিক প্রতিবেদনেও ইউজিসি একই সুপারিশ করেছিল। এমনকি তার আগের বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনেও সন্ধ্যাকালীন কোর্স বন্ধের সুপারিশ ছিল ইউজিসির। কিন্তু ইউজিসির এই সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি।

আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি, টিউশনসহ এ ধরনের ফি যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণের সুপারিশ করে ইউজিসি। ছয় বছর আগে ইউজিসির ৪০তম বার্ষিক প্রতিবেদনেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ধরনের ফি সহনীয় রাখার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয়নি।

ইউজিসিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বার্ষিক প্রতিবেদনে সুপারিশ ছাড়াও সংস্থাটি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়। কিন্তু সেগুলোও খুব একটা গুরুত্ব পায় না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বড় আকার ধারণ করলে কখনো কখনো কোনো উপাচার্যকে সরিয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু অনিয়মের শাস্তি হয় না।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইউজিসি কেবল সুপারিশ করে। কিন্তু কার্যকর তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা না থাকায় শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অনেকে উচ্চশিক্ষা দেখভালের দায়িত্বে থাকা সংস্থাটিকে ‘নখদন্তহীন বাঘ’ বলে থাকেন।

দীর্ঘদিন ধরে ইউজিসিকে আইনগতভাবে আরও কার্যকর ও শক্তিশালী করার পরামর্শ আছে। আছে আলোচনা। কিন্তু সেটিও বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

ইউজিসির এবারের বার্ষিক প্রতিবেদন সম্পাদনা পরিষদের প্রধান সম্পাদক ও সংস্থাটির সদস্য অধ্যাপক মো. সাজ্জাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মতামত ও সুপারিশ দেওয়া ইউজিসির কাজের অংশ। ইউজিসির সুপারিশের বাস্তবায়ন হয়তো অনেক হয়। আবার অনেকগুলো হয়তো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় থাকে। তাঁরা আশা করেন, তাঁদের সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হবে। ইউজিসির কার্যকর ক্ষমতা বাড়াতে হবে, এটি তাঁরা সব সময়ই বলে আসছেন। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষায় আরও বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

দেশের উচ্চশিক্ষাকে যুগোপযোগী করার পাশাপাশি দেখভালের জন্য ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় ইউজিসি। পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউজিসি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিধিবদ্ধ হয়।

মাত্র ৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ইউজিসির যাত্রা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট বিশ্ববিদ্যালয় ১৫৭টি।

আইনানুযায়ী, ইউজিসিকে প্রতিবছর কমিশন ও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বার্ষিক কার্যক্রমের তথ্য-উপাত্তসংবলিত পরিসংখ্যানভিত্তিক প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিতে হয়। সরকারের মাধ্যমে এই প্রতিবেদন জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়।

ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে ৫০টি পাবলিক ও ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোয় সব মিলিয়ে (অধিভুক্ত ও অঙ্গীভূত কলেজ-মাদ্রাসাসহ) মোট শিক্ষার্থী ৪৬ লাখ ৯০ হাজার ৮৭৬ জন।

প্রতিবেদনটিতে দেশের উচ্চশিক্ষাকে বিশ্বমানে উন্নীত করতে ২০টি সুপারিশ করেছে ইউজিসি, যার মধ্যে বেশ কিছু সুপারিশ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গতবার বা তার আগেও করেছিল ইউজিসি।

সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসম্পন্ন শিক্ষক তৈরি করতে ইউনিভার্সিটি টিচার্স ট্রেনিং একাডেমি, উন্নত মানের গবেষণা করার জন্য কেন্দ্রীয় গবেষণাগার (সেন্ট্রাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি) ও গবেষণার প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র চিহ্নিত করার জন্য জাতীয় গবেষণা কাউন্সিল (ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল) প্রতিষ্ঠা করা জরুরি বলে সুপারিশ করে। এই তিনটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের সুপারিশ আগের প্রতিবেদনেও হুবহুভাবে করা হয়েছিল। এমনকি ২০১৮ সালের প্রতিবেদনেও ইউনিভার্সিটি টিচার্স ট্রেনিং একাডেমি প্রতিষ্ঠার সুপারিশ ছিল।

ইউজিসিকে বাস্তবায়নযোগ্য পরামর্শ দিতে হবে। আর সরকারের উচিত হবে সেগুলো বাস্তবায়ন করা। এ ছাড়া ইউজিসিকে আরও শক্তিশালী সংস্থায় উন্নীত করা জরুরি।
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, সাবেক চেয়ারম্যান, ইউজিসি

দেশে উচ্চশিক্ষা স্তরে চার বছর মেয়াদি স্নাতক ডিগ্রিকে প্রান্তিক (টার্মিনাল) ডিগ্রি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কাজেই স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম কেবল বাছাই করা মেধাবী স্নাতকদের জন্য উন্মুক্ত রাখার পরামর্শ সর্বশেষ প্রতিবেদনে দিয়েছে ইউজিসি। ইউজিসির ৪১তম বার্ষিক প্রতিবেদনেও এই সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় তা মানা হচ্ছে না।

৪৭তম বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির (প্লেজিয়ারিজম) ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ নিয়ে কোনো নীতিমালা না থাকায় গবেষণাপত্রে চুরির বিষয়টি সংজ্ঞায়িতও করা যাচ্ছে না। তাই এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করা আবশ্যক। এ ছাড়া গবেষণাকর্মের মান নিয়ন্ত্রণ ও তদারকের জন্য প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি বাংলা গবেষণা ও পুস্তকের জন্য এ ধরনের উন্নত মানের সফটওয়্যার তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে বলা হয়। এ নিয়ে হুবহু সুপারিশ ছিল গতবারের প্রতিবেদনেও।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি ফি, টিউশন ফি, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ইত্যাদি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে ভিন্নতা, তথা অসামঞ্জস্য রয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের নম্বরপত্র, সনদ, প্রশংসাপত্র ইত্যাদি দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চহারে ফি নিয়ে থাকে। এমনকি কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই প্রতিবছর টিউশন–ভর্তি ফিসহ অন্যান্য ফি বাড়ানোর অভিযোগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে রয়েছে। এ জন্য এসব বিষয়ের ফি যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণের সুপারিশ সর্বশেষ প্রতিবেদনে করেছে ইউজিসি। সংস্থাটি বলেছে, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকার নির্দেশনা দিতে পারে বলে মনে করে ইউজিসি।

ইউজিসির ৪০তম বার্ষিক প্রতিবেদনেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ধরনের ফি সহনীয় রাখার সুপারিশ করা হয়েছিল। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেওয়া ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই প্রতিবছর টিউশন–ভর্তি ফিসহ অন্যান্য ফি বৃদ্ধি করে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন যুগোপযোগী করার সুপারিশও সর্বশেষসহ ইউজিসির গত তিনটি বার্ষিক প্রতিবেদনে আছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন নেই।

দীর্ঘদিন ধরে ইউজিসিকে আইনগতভাবে আরও কার্যকর ও শক্তিশালী করার পরামর্শ আছে। আছে আলোচনা। কিন্তু সেটিও বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত বেতনকাঠামো, চাকরি প্রবিধানমালা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয়েছে সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে। ইউজিসির গতবারের প্রতিবেদনেও হুবহু এই সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি।

ইউজিসি ৪৭তম বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে, বর্তমানে কোনো কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের বিদ্যমান আর্থিক নিয়মাবলির ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে। এ জন্য স্বায়ত্তশাসন সমুন্নত রেখে একটি ‘সমন্বিত আর্থিক নীতিমালা ও ম্যানুয়েল’ প্রণয়নের জন্য ইউজিসি কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারে। গতবারের প্রতিবেদনেও একই রকমের সুপারিশ করেছিল ইউজিসি।

ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনের এ রকম অনেক সুপারিশই শুধু কাগজে থেকে যায়। এ বিষয়ে সরকারের বক্তব্য জানার জন্য শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

জানতে চাইলে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমত ইউজিসির সুপারিশগুলো হতে হবে খুবই সুচিন্তিত ও বাস্তবায়নযোগ্য। এমন সুপারিশের পর সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য তাদের লেগে থাকতে হবে। এখানে অবশ্যই সরকারের ভূমিকা আছে। সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি সহযোগিতা না করে, তাহলে ইউজিসির সুপারিশ তো কথার কথা হবে। অর্থাৎ, ইউজিসিকে বাস্তবায়নযোগ্য পরামর্শ দিতে হবে। আর সরকারের উচিত হবে সেগুলো বাস্তবায়ন করা। এ ছাড়া ইউজিসিকে আরও শক্তিশালী সংস্থায় উন্নীত করা জরুরি।

৪৭তম বার্ষিক প্রতিবেদন.pdf