সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন পরিকল্পিত ও জন-অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতির অনুশীলন

‘দ্য কোভিড–১৯ লার্নিং, এভিডেন্স অ্যান্ড রিসার্চ প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ গবেষণা প্রকল্পের চূড়ান্ত সম্মেলনে অতিথিরাছবি: লেখক

কোভিডের বহুমাত্রিক সংকট বুঝতে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের ‘ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (আইডিএস)’, বাংলাদেশের ‘ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি)’ যৌথভাবে ‘দ্য কোভিড–১৯ লার্নিং, এভিডেন্স অ্যান্ড রিসার্চ প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ (CLEAR)’ শিরোনামে গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করে। যেটির অর্থায়ন করেছে যুক্তরাজ্য সরকারের ‘ফরেইন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও)।’

বিআইজিডি, আইডিএস ও ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স যৌথভাবে গত ৩ থেকে ৫ মার্চ ২০২৪–এ ঢাকার বিআইডিএ ভবনে গবেষণা প্রকল্পটির চূড়ান্ত সম্মেলন আয়োজন করে। সম্মেলনে CLEAR প্রকল্পের গবেষণাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল তুলে ধরা হয়। তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলনের প্রধান উদ্যোক্তা ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের ‘আইডিএস’ বিভাগের সিনিয়র ফেলো সোহেলা নাজনীন, যিনি CLEAR প্রকল্পের গবেষণাগুলোর সরাসরি তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন। এ ছাড়া সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন, ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, অধ্যাপক নাওমি হোসেন ও আনীর চৌধুরী। আরও উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক শাহাদুজ্জামান, অধ্যাপক এস আর ওসমানী, আসিফ শাহান, মুস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।

আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ জহিরুল কাইয়ুম, বাংলাদেশ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ‘CLEAR’ প্রকল্পের অ্যাডভাইজরি বোর্ডের ফেলো রওনক জাহান, সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কবির চৌধুরী, পিকেএসএফের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কাদের, পিপিআরসির নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমানসহ বিশিষ্টজনেরা। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ব্রিটিশ হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার ও উন্নয়ন নির্দেশক ম্যাট ক্যানেল।

সম্মেলনের ছয়টি সেশন যেসব প্রশ্ন ঘিরে আবর্তিত হয়েছে সেগুলো হলো কোভিড প্রতিরোধে বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায় থেকে কী ধরনের পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে, সংকট মোকাবিলার কোন সুযোগগুলোকে আমরা কাজে লাগাতে পারিনি, সংকটকে বোঝা ও তা নিরসনের যে জ্ঞান এত দিন প্রচলিত ছিল সেখানে কী ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে, দ্রুত ও বিশ্বাসযোগ্য, সংকট নিরসনের প্রচেষ্টা কি শেষ এবং আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে যাচ্ছে?

দারিদ্র্যের বহুমাত্রিক সংকট ও সংকট উত্তরণে গৃহীত কৌশল

বাংলাদেশে দারিদ্র্যের বহুমাত্রিকতা বুঝতে ‘কোভিড–১৯ লার্নিং, এভিডেন্স অ্যান্ড রিসার্চ প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ (CLEAR)’ গবেষণা প্রকল্পের আওতায় যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারের ‘গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট এবং সানেম বাংলাদেশ (SANEM Bangladesh) দুটি পর্যায়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে দেখা গেছে, কোভিডের প্রভাবে দারিদ্র্য আবার বেড়েছে, গ্রামের তুলনায় শহরে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। দেশে ফেরত আসা অভিবাসীদের মধ্যে ২৭ শতাংশ বেকার হয়ে পড়েছে, যেটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দারিদ্র্য বৃদ্ধিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। কোভিডে নতুন দরিদ্র মানুষ বিভিন্ন উপায়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে। যেমন জীবনযাপনের ব্যয় কমিয়েছে (৮৫ শতাংশ), খাদ্যাভ্যাসে বদল এনেছে (৩১ শতাংশ), সঞ্চয় কমিয়েছে (২৪ শতাংশ), অন্যান্য ব্যয় কমিয়েছে (২৪ শতাংশ) এবং ঋণ নিয়েছে (১২ শতাংশ)।

কোভিডে নতুন দরিদ্র মানুষেরা এ ধাক্কা সামলাচ্ছে সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন সহায়তা, ব্যক্তিগত ঋণ, মূল্যবান জিনিস বন্ধক রাখা, পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা, বিকল্প কাজ খোঁজা প্রভৃতি কৌশলের মাধ্যমে। কিন্তু পরিবারের বাইরে অন্যদের কাছে সাহায্য চাওয়া বা লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নেওয়া এই নতুন দরিদ্র মানুষদের জন্য লজ্জাজনক।

কোভিডে শিক্ষায় বেহাল দশা: ক্ষতি প্রশমনে ডিজিটাল পদ্ধতি কি কার্যকর ছিল করোনায় বাংলাদেশে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ ছিল। শিক্ষাক্ষেত্রে ক্ষতি কমাতে সরকার ডিজিটাল শিক্ষাপদ্ধতির ব্যবহার বৃদ্ধির কথা বলে। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায়, গ্রামে বসবাসকারী মেয়েশিশু, দরিদ্র, নিরক্ষর বা কম শিক্ষিত পরিবারের ছেলেমেয়েরা রিমোট লার্নিং বা ডিজিটাল শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে বিভিন্ন কারণে, যেমন প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি না থাকা, ইন্টারনেট সংযোগ না থাকা, পর্যাপ্ত ইন্টারনেট সুবিধা না থাকা ইত্যাদি।

ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা কি সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছে?

ব্র্যাক জেপিজিএসপিএইচে পরিচালিত CLEAR–এর এক গবেষণায় দেখা যায়, করোনাকালে ২ হাজার ৪০০ নমুনার মধ্যে ৯৯ শতাংশ ভ্যাকসিন দিয়েছে, এর ৮৬ শতাংশ ই–সুরক্ষা অ্যাপের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করেছে, করোনাসংক্রান্ত ৩৪ শতাংশ তথ্য পেয়েছে বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও বিটিভির মাধ্যমে, সামাজিক ও মুঠোফোনে খুদে বার্তার মাধ্যমে জেনেছে ৩৯ শতাংশ। তবে ডিজিটাল সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষের যথাযথ সুবিধা ভোগ করতে পারেনি। গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৬ দশমিক ৫ শতাংশ ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবায় নয় বরং সরাসরি চিকিৎসাসেবা গ্রহণে বেশি আগ্রহী। এর উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে উঠে এসেছে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে অনভিজ্ঞতা।

গবেষণা প্রকল্পের সম্মেলনে অতিথিরা
ছবি: লেখক

সংকট প্রশমনে তরুণ সমাজ কী করেছে

কোভিডকালে তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে CLEAR সম্মেলনে একটি সেশন পরিচালনা করেন ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক আদনান ফকির ও বিআইজিডির যোগাযোগ সহযোগী তাহমিদ হাসান। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন লাইটশোর ফাউন্ডেশন, পাশে আছি ইনেশিয়েটিভ, ইয়ুথ ফর পলিসি, ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস, দ্য রেসিসট্যান্স–এ ফেমিনিস্ট নেটওয়ার্ক, ট্রান্সএন্ড, বাংলাদেশ হুইলচেয়ার ক্রিকেট, ইটস হিউমিনিটি ফাউন্ডেশন, ভলান্টিয়ার অপরচুনিটিজ ও বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধিরা। আলোচনা থেকে উঠে আসে তাদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা। যেমন কোভিডে ইটস হিউমিনিটি ফাউন্ডেশন প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক অনলাইনভিত্তিক শিক্ষাদান পদ্ধতির পরিবর্তে ‘উঠান পাঠশালা’ কার্যক্রম শুরু করেন। ট্রান্সএন্ড ও দ্য রেসিসট্যান্স–এ ফেমিনিস্ট নেটওয়ার্ক—কোভিডের সময়ে বিভিন্ন এনজিও থেকে তহবিল সংগ্রহ করে ‘হিজড়া’ গোষ্ঠীকে সাহায্য করেছে। আবার খুলনায় কোভিড ও এর টিকাসম্পর্কিত নানা গুজব এড়িয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে এবং টিকা গ্রহণ নিশ্চিত করতে ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস কাজ করেছে। গারো, হাজং, মণিপুরিসহ যারা প্রান্তিক গোষ্ঠী এবং প্রায়ই মূলধারার অন্তর্ভুক্ত হয় না, তাদেরকে খাদ্য সহযোগিতার পাশাপাশি তাদের জন্য একটি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেছে লাইটশোর ফাউন্ডেশন।

সামাজিক সুরক্ষানীতি আসলে কেমন হওয়া উচিত

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে জরুরি ভিত্তিতে দুর্যোগ মোকাবিলার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সামাজিক সুরক্ষানীতি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের আইডিএস বিভাগের রিসার্চ ফেলো ড. কেট প্রুস বলেন, কোভিড হচ্ছে সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থাকে জোরদার করার জন্য একটি ওয়েক আপ কল। প্রয়োজন টার্গেট জনগণ নির্ধারণ ও তাদেরকে পলিসিতে অন্তর্ভুক্তকরণ। সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের (SOAS University of London) অধ্যাপক ড. নাওমি হোসাইন বলেন, সামাজিক সুরক্ষানীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে খেয়াল রাখতে হবে যাতে দরিদ্র এবং প্রান্তিক মানুষ নীতির বাইরে না থেকে যায়।

পরিশেষে ‘কোভিড–১৯ লার্নিং, এভিডেন্স অ্যান্ড রিসার্চ প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশের (CLEAR)’ মাধ্যমে স্থানীয় জ্ঞানের সঙ্গে বৈশ্বিক জ্ঞানের সংযুক্ততা তৈরি হয়েছে এবং জ্ঞান উৎপাদনের ক্ষেত্রে সম-অংশীদারত্ব বা সমতা বজায় রাখার চর্চা শুরু হয়েছে, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

ব্রিটিশ হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার ম্যাট ক্যানেল অর্থায়নের উদ্যোগ নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে অর্থায়ন ও ন্যায়সংগত অংশীদারত্ব জ্ঞান উৎপাদনকে শক্তিশালী করে। সেই সঙ্গে এটি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

আরও পড়ুন

ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের আইডিএস বিভাগের সিনিয়র ফেলো সোহেলা নাজনীন বলেন, ‘কোভিডে বাংলাদেশের যে অভিজ্ঞতা, কোভিড মোকাবিলার যে ধরন, রাষ্ট্রীয় যে নীতি ও অনুশীলন এবং এ–সম্পর্কিত যে বয়ান সেটি ব্যক্তিভেদে, প্রেক্ষিতভেদে ভিন্ন। এ ছাড়া কে জ্ঞান উৎপাদন করছে, উৎপাদিত জ্ঞান আসলে কার জন্য ও কার উৎপাদিত জ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ—এসব বিষয় আমাদেরকে বিবেচনায় রাখতে হবে। কারণ, জ্ঞান উৎপাদনের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক রয়েছে। প্রেক্ষিতভেদে জ্ঞান কেন ভিন্ন হচ্ছে সেই প্রশ্নের অনুসন্ধান জরুরি।’

বাংলাদেশে দুর্যোগের আবির্ভাব ও তা মোকাবিলায় সরকারি, বেসরকারি, কমিউনিটিভিত্তিক এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী প্রশংসনীয়। তবে সরকারি–বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি কমিউনিটির যে সক্রিয় ভূমিকা সেটি অনস্বীকার্য। এ ব্যাপারে বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন বলেন, ‘সংকট মোকাবিলায় আমাদের অনানুষ্ঠানিক ও কমিউনিটিচালিত পদ্ধতি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনারই অংশ। কমিউনিটির শক্তিকে সংঘবদ্ধ করাটা জরুরি। এ ছাড়া প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আমরা কোনটা গ্রহণ এবং কোনটা বর্জন করব, সে ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।’

লেখক: বাংলা কনটেন্ট এডিটর, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি), ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি