একটি রাষ্ট্রকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যেতে হলে নারীর ভূমিকা অপরিসীম। সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের অর্ধেক অংশজুড়ে যে নারী সমাজের অস্তিত্ব, কর্মক্ষেত্রে তাঁর অবাধ বিচরণ হওয়া জরুরি। বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বদ্ধপরিকর, যার ৫ নম্বর লক্ষ্যটিই নারী-পুরুষের সমতা বিধানের জন্য রাখা হয়েছে।
সমান ও সমতা
সমান এবং সমতা শব্দ দুটি বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে উন্নত দেশের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন অর্থ বহন করে। যখন নারী-পুরুষ উভয়ের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের স্বাধীনতা সমান হারে সৃষ্টি করা হয়, তখন সেখানে সমতা আর সমান একই অর্থ বহন করে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে শহুরে অঞ্চল বাদ দিলে অনেক গ্রামে নারীরা এখনো নিজের পেশা বাছাই এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুরুষের মতো সমান স্বাধীনতা পায় না। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক কিংবা বৃহৎ অর্থে রাষ্ট্রের অর্থনীতির চাকা দুর্বল হয়ে যায় এই পিছিয়ে পড়া নারীদের জন্য।
২০৩০–এর এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কিংবা ২০৪১–এর উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মতো দুটো স্বপ্নই দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে, যদি নারীসমাজ কর্মক্ষেত্রে নিজেদের মেধা, মনন, সৃজনশীলতার পরিচয়কে ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়।
‘উন্নত বাংলাদেশ’ বলতে এমন এক বাংলাদেশকে বোঝানো হয় যেখানে শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি—সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ সমানতালে এগিয়ে যাবে। তাই এই নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় নারীদেরও এগিয়ে আসতে হবে অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে।
হতে হবে বিশ্বনাগরিক
বিশ্বনাগরিক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার মতো স্বপ্ন নিয়ে দুর্বার গতিতে নারীদের ছুটে চলতে হবে। শুধু নির্দিষ্ট কিছু সেক্টর যেমন গার্মেন্টস, শিক্ষক, ডাক্তার কিংবা ব্যাংকের একটা সাদামাটা চাকরির বাইরে নিজের স্বপ্নকে মেলে ধরতে হবে।
কেন একজন নারীর নাসার গবেষক হওয়ার স্বপ্ন অলীক হবে? ২০২১–এর বাস্তবতায় ১৯ বছরে যে বাংলাদেশ বিশ্বমানচিত্রে নারীর ক্ষমতায়নে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চায়, সেখানে নারীদের হতে হবে গবেষক, বিজ্ঞানী এবং সর্বোপরি সৃজনশীল মননের। যে মনন চিন্তার দ্বারকে রুদ্ধ হতে দেয়, তার সৃজনশীলতার বিকাশ অসম্ভব।
বড় বড় প্রতিষ্ঠানে নারীরা নেতৃত্বে আসছেন। বাংলাদেশের ডিএসই লিস্টে থাকা ৩১২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২২৪টিতেই নারীরা পরিচালনা পর্ষদে আছেন। এই পরিসংখ্যান নারীর নেতৃত্বগুণকে প্রকাশ করে।
যে নারী রাজনীতির মাঠে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন, সেই একই নারী কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে থেকে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখছেন। আবার খেলাধুলার মাঠে এই নারীরাই বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশের পতাকার সম্মান বৃদ্ধি করছে। অর্থাৎ, ইচ্ছাশক্তি এবং স্বপ্নের কাছে যেকোনো বাধাই হার মানতে বাধ্য। নারীর মুক্তির বার্তা তার শিক্ষা ও জ্ঞানের মধ্যে। সীমাবদ্ধ জ্ঞান ব্যক্তির বুদ্ধিকে আড়ষ্ট করে দেয়। নারীদের শিক্ষিত হতে হবে।
উদ্ভাবনেই উন্নতি
করপোরেট চাকরির পাশাপাশি ব্যক্তির ইচ্ছা অনুযায়ী উদ্যোগী হতে হবে। নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে প্রচলিত সমস্যা সমাধানে উদ্ভাবনী কর্ম সৃজন করতে হবে। নিজের জন্য কর্মসংস্থানের পাশাপাশি এমন কিছু করতে হবে, যাতে সমাজের অন্য কারও উপকার হয়। গ্রামে নারীরা বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প নিয়ে ছোট আকারে কাজ করছে। এটিকে বৃহৎ আকারে নতুন কোনো প্ল্যাটফর্মে এনে সৃজনশীলভাবে কাজ করা যেতে পারে। উচ্চশিক্ষায় মেয়েদের দেশের বাইরে বৃত্তি নিয়ে পড়তে যেতে হবে।
১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সরকার নারীদের যে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে, তার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নারীদেরই নিশ্চিত করতে হবে। লেদার, পোশাকশিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি, পর্যটন, পাটশিল্প, রোবটিকস থেকে শুরু করে সব খাতে নারীদের নিজের আগ্রহ নিয়ে ছড়িয়ে পড়তে হবে।
পোশাকশিল্প আর বৈদেশিক আয়ের ওপর ভরসা করে একটি দেশের অর্থনীতি দীর্ঘ মেয়াদে লক্ষ্যচ্যুত হবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই বাকি যে ক্ষেত্রগুলো আছে সেখানে নারীদের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত এবং স্বতঃস্ফূর্ত হতে হবে।
এখনো উচ্চশিক্ষিত অনেক মেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে শেখেননি। কেন এঁদের সামনে আইডল হিসেবে দেশের প্রথম নারী বৈমানিক কানিজ ফাতেমা রোকসানারা থাকেন না? তাহলে কি আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানসিকতার পরিবর্তন আবশ্যক। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় কিছু মানুষ সব সময়ই নারী শিক্ষা এবং প্রগতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করবে। এ জন্যই নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়াদের প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে কলম ধরতে হয়েছিল। সময় অনেকটা পেরিয়েছে, তাই এখন সমাজের সর্বস্তরে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ধারা প্রবাহিত হতে হবে।
কর্মক্ষেত্রে নারীর স্বাধীনতা কিংবা তার অধিকার সবকিছুর জন্যই নারীদের মুখ্য ভূমিকা রাখতে হবে। নারীর ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনদের মতো মানুষের অবদানেই ১৯১৮ সালে নারী তার ভোটাধিকার পায় আর ১৯১১ থেকে নারী দিবস প্রতিষ্ঠা হয়। ১০০ বছর আগে নারীদের জন্য যে সংগ্রাম শুরু হয়েছে, আজ এতকাল পর বাংলাদেশের নারীদের সৃজনশীল কাজে পিছিয়ে পড়া খুব বেশি বেমানান।
চাই প্রযুক্তির জ্ঞান
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কাছাকাছি চলে এসেছে পুরো বিশ্ব। এমন একটি সময়ে প্রযুক্তিগত জ্ঞানে পিছিয়ে পড়া মানে পুরো পৃথিবী থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার সমান। বিষয়টি মাথায় রেখে নারীদের প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মতো যোগ্য করে গড়ে উঠতে হবে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে পিছিয়ে পড়া, শিক্ষাবঞ্চিত নারীদের কীভাবে সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ হিসেবে তৈরি করা যায়, তা ভাবতে হবে।
পারিবারিক দায়বদ্ধতার কারণে যেসব নারী কর্মজীবনে প্রবেশ না করার কথা ভাবছেন, তাঁদের ব্যক্তিজীবন আর কর্মজীবনে ভারসাম্য আনার বিষয়টি ভাবতে হবে। মাথাব্যথা হলে যদি আপনি মাথা না কেটে ওষুধ খাওয়ার কথা চিন্তা করেন, তাহলে পারিবারিক কাজের জন্য নিজের কর্মজীবন নষ্ট করে উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহারে এখন ঘরোয়া কাজ অনেক সহজ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের রেস্টুরেন্টেই এখন রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে মানুষের বদলে। তাহলে আগামী দিন কী হতে পারে, সেটা সহজেই অনুমেয়। এই আগামীর পরিবর্তনের জন্য কি বাংলাদেশ এবং নারীসমাজ প্রস্তুত?
যে নারী বাইরে কাজ করতে আগ্রহী নন, তিনি এখন বাসায় বসে অনলাইনে ব্যবসা করতে পারছেন। বিভিন্ন পণ্য নিয়ে প্রচুর পরিমাণ মূলধন বিনিয়োগ করে যাঁর কাজ করার সাধ্য নেই, তিনি এখন প্ল্যাটফর্ম বিজনেস নিয়ে ভাবতে পারছেন। এটাই প্রযুক্তির সৌন্দর্য।
পরিবার কোনো দিন বাধা নয়। নারীর নিজের মানসিকতা আগে ইতিবাচকভাবে পরিবর্তন করতে হবে।
নিশাত মজুমদারেরা যদি এভারেস্ট জয় করতে পারেন, তাহলে বাকিরা পারবেন না কেন? বাধা ডিঙিয়ে যদি রুবানা হক দেশের প্রথম নারী হিসেবে বিজিএমইএর সভাপতি হতে পারেন, কিংবা সুসানে গীতি প্রথম নারী মেজর জেনারেল হতে পারেন, বাকিরা পিছিয়ে পড়বেন কেন? এই মানুষেরা নিজেকে নিজেদের স্বপ্নের সমান বড় প্রমাণ করেছেন। দেশের প্রথম নারী শিক্ষামন্ত্রী হয়েছেন ডা. দীপু মনি। একজন চিকিৎসক হয়েও শিক্ষা ক্ষেত্র এবং আইন বিভাগে সমানতালে অবদান রাখছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাসিনা খানের গবেষণা দলের ইলিশের জিন বিন্যাস বা জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার দেশের নারী গবেষকদের জন্য অনুকরণীয়। কোন নারীকে জীবনে রোল মডেল হিসেবে নিজের সামনে রাখবেন, সেটি নির্ধারণ করুন। অন্য একজন নারী পারলে আপনি কেন পারবেন না, সেই প্রশ্ন ছুড়ে দিন নিজেকে।
রাশেদুর রহমান: নির্বাহী পরিচালক; ইনোভেশন, ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ সেন্টার, সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জুবেলী খানম: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়