আমরা ভর্তি পরীক্ষা দিলাম ৫৯ জন। সেখান থেকে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলাম ৩১ জনের মতো। চারুকলায় এত ছাত্র ভর্তি পরীক্ষা দিল, তাতেই অনেকের চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়!
গল্পটা ১৯৫৯ সালের। ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্টস প্রতিষ্ঠার ১১তম বর্ষ সেটা। আমাদের আগের ব্যাচের চিত্র কেমন ছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনও শুনেছি, আর্ট স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য শুরুতে নাকি ছাত্র ডেকে ডেকে আনা হতো। আর এখন? ২০১৮ সালে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার ছাত্রছাত্রী।
এই যে চারুকলার অবস্থান, তা কিন্তু এক দিনে তৈরি হয়নি। এই যাত্রাটা ৭০ বছরের। এর গোড়াপত্তনে রয়েছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে কয়েকজন দূরদর্শী মানুষের স্বপ্ন, নিরন্তর সাধনা, চেষ্টা, পরিশ্রম।
শূন্য থেকে শুরু
তখন পাকিস্তান আমল। চারুকলার ক্ষেত্রটা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে শূন্যগর্ভ। যা ছিল, তা আমাদের এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ লোকশিল্প। কিন্তু লোকশিল্প আধুনিকভাবে চর্চা করার খামতি আমাদের ছিল। যাঁরা আধুনিক শিল্পের চর্চা করতেন, তাঁদের যাতায়াত ছিল কলকাতায়। সে শহরই তো তখন শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র।
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত নিজস্ব ব্যাপার আছে। সেই ব্যাপারের মধ্যে শিল্পকলা থাকবে না, তা কী করে হয়। সে চিন্তাই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও তাঁর সমসাময়িক শিল্পীরা করেছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন এবং উদ্যোগ নিয়েছিলেন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার।
তবে সেই প্রতিষ্ঠান করার জন্য তৎকালীন সরকারকে বোঝাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। অবশেষে ১৯৪৮ সালে ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউটের দুটি ঘর নিয়ে ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্টস যাত্রা শুরু করল। প্রথম ব্যাচের ছাত্রসংখ্যা ১৮।
একসময় সেখানে জায়গার সংকুলান হচ্ছিল না। ১৯৫১ সালে সেগুনবাগিচায় একটি বাড়ি বন্দোবস্ত করা হলো। সেখানে চলল কয়েক বছরের শিক্ষা কার্যক্রম।
নিজস্ব প্রাঙ্গণের স্বপ্ন
আর্ট কলেজের একটা নিজস্ব প্রাঙ্গণ থাকবে। সেই প্রাঙ্গণের ভবনটি শুধু ইট-কাঠ-বালু-সুরকির কাঠামো না হয়, তা যেন মানুষের চোখে ভালো লাগে। এমন ভাবনা নিয়েই ভবন নকশার কাজটি করেন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। তাঁকে সরকারিভাবেই ভবন নকশার দায়িত্বটি দেওয়া হয়েছিল। তিনি নিমগ্ন হলেন নকশা করতে। তৈরি করলেন অসাধারণ একটি স্থাপত্য।
শিল্পীদের সম্পর্কে মানুষ যা ভাবতেন, তা যেন এই ভবন দেখেও পরিবর্তন হতে থাকল। তিনি এত ‘স্মার্ট’ একটা ভবন তৈরি করলেন, চারুকলা সম্পর্কে সে সময়ের মানুষের ধারণাই বদলে গেল। ভবনের মধ্যেই ফুটে উঠল শিল্পীদের রুচিচর্চার বিষয়টি। এখনো তো আধুনিক একটি ভবন সেটা।
সেগুনবাগিচার বাড়ি ছেড়ে সেই আধুনিক ভবনে চারুকলা চলে এসেছিল ১৯৫৬ সালে।
রুচি শিক্ষার নীরব আন্দোলন
১৯৫৯ সালে আমরা পড়তে এসেছিলাম। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাচ বেরিয়ে গেছে। পাস করা ছাত্রদের অনেকেই তখন দেশের মস্ত বড় শিল্পী। প্রতিবছর জাতীয় পুরস্কার পাচ্ছেন তাঁদের কেউ কেউ। আমিনুল ইসলাম, আবদুর রাজ্জাক, কাইয়ুম চৌধুরী, কাজী আবদুল বাসেত, রশীদ চৌধুরীর মতো প্রাক্তনদের অনেককেই আমরা আবার শিক্ষক হিসেবে পেলাম। সেই সঙ্গে পেলাম প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, আনোয়ারুল হক, সফিউদ্দিন আহমেদ, শফিকুল আমীন, কামরুল হাসানের মতো উজ্জ্বল ব্যক্তিদেরও।
প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষকেরা এসেছিলেন কলকাতা আর্ট কলেজ পাস করে। তাঁদের প্রত্যেকেই আবার ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে উচ্চতর পড়াশোনাও করেছিলেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শিল্পকলা সম্পর্কে প্রত্যেকেরই অগাধ জ্ঞান। সবাই সমৃদ্ধ মানুষ। আন্তর্জাতিক মানের সে শিক্ষকদের কাছ থেকেই আমরা পেলাম রুচি শিক্ষার মন্ত্র।
আমাদের সময়টায় শিল্পাচার্য প্রশাসনিক কাজে অনেক বেশি ব্যস্ত থাকতেন। দেশ-বিদেশে নানা উদ্যোগে যুক্ত ছিলেন, সশরীরে অংশ নিতেন। কাজের ফাঁকে একটু ফুরসত পেলেই ঢুকতেন ক্লাস নিতে। তাঁর ক্লাসজুড়ে থাকত দেশকাল, সমসাময়িক শিল্পকলাসহ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা। দুর্ভিক্ষের ছবি আঁকা মানুষ তিনি। প্রখরভাবে সে সময়ের সময়-বাস্তবতা তাঁর আলোচনায় চলে আসত। সত্যি বলতে, চারুকলার পড়াশোনাটা শুধু আঁকাআঁকি শেখানো এমন তো নয়। সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়গুলোও সচেতনভাবে চলে আসত আমাদের পাঠ্য অংশে। আমাদের শিক্ষকেরাও সেসব বিষয়ে ছিলেন সচেতন, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুক্ত। আমরা সেই শিক্ষাটা আলোকিত শিক্ষকদের কাছ থেকেই পেয়েছি।
শুধু ৪৫ মিনিটের ক্লাসে নয়। শিক্ষকদের সঙ্গে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকত। অনেক ক্লাস তো আমরা পনেরো দিন ধরেও করেছি। ছবি আঁকা শুধু নয়, জীবনকে নানাভাবে চেনার সুযোগ হলো এখানে ভর্তি হয়ে।
এরপর এখানে যাঁরা পড়তে এলেন, তাঁরা সেই আধুনিকতাকেই বয়ে নিয়ে গেলেন। এখানে যাঁরা শিক্ষক ছিলেন, তাঁরাও উজ্জ্বল। শিল্পকলার সঙ্গে তাঁরা দেশকাল নিয়েও সোচ্চার। ভাষা আন্দোলন থেকে সাংস্কৃতিক প্রতিটি আন্দোলনে আর্ট
কলেজের শিক্ষক-ছাত্রদের সম্পৃক্ততা থাকল।
সেই সঙ্গে যুক্ত হলেন রুচিবোধ তৈরির কাজেও। সেটা অলংকরণ দিয়ে, বইয়ের প্রচ্ছদ, পত্রপত্রিকার বিন্যাস পরিবর্তন করে, পোশাকে, মিছিলের সাদামাটা পোস্টারে। লোকশিল্পের কথা বলেছিলাম। চিরায়ত লোকশিল্পের সঙ্গে আধুনিকতা মিশে নিজস্ব একটি ধরন পেয়েছে। এর পেছনে আর্ট কলেজের অবদান বিশাল। পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা অন্য মাত্রা পেয়েছে চারুকলার আয়োজন শুরুর পর। প্রচ্ছন্নভাবে এমন অনেক রুচি তৈরি করে দিয়েছে চারুকলা।
পরিবর্তনের সাক্ষী
পাঁচ বছরের কোর্স শেষে, ১৯৬৪ সালে চারুকলায় যুক্ত হলাম শিক্ষক হিসেবে। ১৯৬৩ সালে সরকারি কলেজ হিসেবে উন্নীত হলো। ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হলো এটি। ২০০৮ সালে এসে অনুষদ হিসেবে মর্যাদা পেল। অবসর নেওয়ার পরও এখনো যুক্ত আছি। চারুকলার ইতিহাসের প্রায় সব ঘটনার সঙ্গেই যুক্ত থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। কাছে থেকে দেখেছি পরিবর্তনগুলো।
আমাদের সময় তেমন প্রযুক্তিগত ব্যাপারটা ছিল না। এখন ছাত্ররা কম্পিউটার পাচ্ছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্ব শিল্পকলা সম্পর্কে জানছে, সেরা সেরা কাজ ঘরে বসে দেখছে। পৃথিবীর কোথায় কী হচ্ছে, তা জানছে। তারা এসব থেকে ঋদ্ধ হচ্ছে। যা আমরা একসময় শুধুই বই–পুস্তক, পত্রপত্রিকা মারফত পেতাম। এই পরিবর্তনটা ইতিবাচক। ইতিবাচক এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এখনকার শিক্ষার্থীরা আরও বেশি সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
সত্তরে স্বাগত
১৯৪৮ থেকে ২০১৮—এ বছর ৭০ বছর পূর্তি উৎসব হচ্ছে চারুকলার। এটা তো পূর্তি উৎসব শুধু নয়, প্রতিষ্ঠানটির এত বছর হলো তা জানানো শুধু নয়; মানুষ যদি একটু তলিয়ে দেখে, তাহলেই বুঝবে কেন সত্তর বছর গুরুত্বপূর্ণ। দেশের তাবৎ রুচি আর শিল্পকলার যে অবস্থান, তা চারুকলার সত্তর বছরের মধ্যে বিদ্যমান। এই ৭০ বছরে কী হয়েছে তা কিন্তু উন্মোচন হয়।
কোনো প্রতিষ্ঠানের ৭০ বছর হয়তো ঘটা করে উদ্যাপন করা হয় না। এটা হয় ৫০, ৭৫ কিংবা শতবর্ষ উদ্যাপন। চারুকলার পঁচাত্তর বছর পূর্তিতে আমরা কে থাকব, কে থাকব না, তা তো বলা কঠিন। আমাদের জয়নুল উৎসবের সঙ্গে ৭০ বছর পূর্তি উৎসবকে যুক্ত করা হয়েছে। আমি তো ভীষণ খুশি। অন্তত উৎসবে যুক্ত থাকতে তো পারলাম।