পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘একক’ ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে না, এবারও আগের নিয়মেই
আসন্ন ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে দেশের সব কটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ‘একক’ ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত সেটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। নতুন পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিতে ইউজিসি গত ৩১ অক্টোবর ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে স্নাতক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ, ২০২৩’–এর খসড়া চূড়ান্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠালেও সেটি চূড়ান্ত হয়নি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এবারও আগের মতো গুচ্ছ ভিত্তিতেই ভর্তি পরীক্ষা হবে। আজ বুধবার ইউজিসির শুদ্ধাচার কৌশল কর্মপরিকল্পনা–সংক্রান্ত এক সভায় ইউজিসির চেয়ারম্যানের রুটিন দায়িত্বে থাকা সদস্য অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীরও আসন্ন শিক্ষাবর্ষে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা হবে বলে জানিয়েছেন।
গত রোববার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এখন শুরু হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির পরীক্ষাপ্রক্রিয়া। অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর কিছুদিন আগে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘একক’ ভর্তি পরীক্ষাসংক্রান্ত অধ্যাদেশের খসড়া চূড়ান্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন তাঁরা। পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে মন্ত্রণালয়। কিন্তু তখন পর্যন্ত এটি চূড়ান্ত হয়নি। দ্রুত অধ্যাদেশ না হলে এবার নতুন এই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া কঠিন বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।
বর্তমানে দেশে ৫৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এ ছাড়া দেশে অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১১৩টি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আলাদাভাবে ভর্তি করা হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বুয়েট) কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা ভর্তি পরীক্ষা হয়। তবে ২২টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় একটি গুচ্ছভুক্ত হয়, তিনটি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট, কুয়েট ও রুয়েট) আরেকটি গুচ্ছে এবং কৃষি ও কৃষিশিক্ষাপ্রধান সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় অপর একটি গুচ্ছভুক্ত হয়ে ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছে।
রাষ্ট্রপতির অভিপ্রায় অনুসারে ইউজিসি সব বিশ্ববিদ্যালয়কে একক আওতাভুক্ত করে একটি ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছিলঅধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর
ইউজিসির মূল্যায়ন হলো, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি কার্যক্রমে জটিলতা, দীর্ঘসূত্রতা, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নিরাপত্তাহীনতা ও দুর্ভোগ, অতিরিক্ত টাকা ব্যয় এবং সময়ক্ষেপণ হয়। এ জন্য বিদ্যমান ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সংস্কার প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতিও সমন্বিত কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা চালুর অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন।
এ রকম পরিস্থিতিতে আসন্ন শিক্ষাবর্ষ থেকে সমন্বিত কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষার উদ্যোগ নেয় সরকার। পরিকল্পনা অনুযায়ী, নতুন নিয়মে তিন বিভাগের (বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা) শিক্ষার্থীদের জন্য তিনটি আলাদা পরীক্ষা নিয়ে একটি ‘স্কোর’ দেওয়ার কথা। কোনো শিক্ষার্থী বিভাগ পরিবর্তন চাইলে সেই সুযোগও এর মধ্যে রাখা হবে। এরপর এই স্কোরের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এর মানে হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আলাদাভাবে কোনো পরীক্ষা নিতে পারবে না।
ইউজিসির পরিকল্পনা হলো ভারতের মতো নতুন নিয়মে ভর্তি পরীক্ষা নিতে ন্যাশনাল টেস্টিং অথরিটি (এনটিএ) নামের পৃথক একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। এই কর্তৃপক্ষের অধীন হবে ভর্তির পরীক্ষা। কিন্তু আসন্ন শিক্ষাবর্ষে এনটিএ গঠন করে নতুন এ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার মতো সময় নেই। তাই ইউজিসির তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। যেহেতু নির্বাচনকালে এখন জাতীয় সংসদের অধিবেশন নেই, তাই ইউজিসি এবার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ গঠন করে নতুন পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল।
ইউজিসি সূত্রে জানা যায়, এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩১ অক্টোবর অধ্যাদেশের খসড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ওই খসড়ায় বলা হয়, ‘আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইন, সংবিধি, বিধি, প্রবিধি বা আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন অন্য কোনো দলিলে যা কিছু থাকুক না কেন, এ অধ্যাদেশের বিধানাবলি প্রাধান্য পাবে। এই কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা শুধু দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রযোজ্য হবে।’
খসড়া অনুযায়ী, ইউজিসির চেয়ারম্যান হবে এই কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান। এ ছাড়া সদস্য হিসেবে থাকবেন ইউজিসির দুজন সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা। এ ছাড়া অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের মধ্যে চারজন উপাচার্য (ইউজিসির চেয়ারম্যান মনোনীত)। আর ইউজিসির একজন পরিচালক পদমর্যাদার নিচে নন, এমন একজন কর্মকর্তা কর্তৃপক্ষের সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন।
খসড়া অনুযায়ী এই কর্তৃপক্ষ ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে নিজস্ব শর্তাবলি অনুযায়ী এই ফলাফলকে মূল ভিত্তি ধরে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) বা সমমান ও উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) বা সমমান পরীক্ষার ফলাফলকে বিবেচনায় নিয়ে মেধাক্রম করে ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করবে। তবে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় চাইলে সীমিত পর্যায়ে শুধু সংগীত, চারুকলা, নৃত্যকলা, নাট্যকলা, স্থাপত্যবিদ্যা বা এ-জাতীয় অতি বিশেষায়িত বিষয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে ‘স্ট্যান্ডার্ড অ্যাপটিটিউড টেস্ট’ গ্রহণ করতে পারবে।
খসড়া অনুযায়ী এইচএসসির ফল প্রকাশের পর ভর্তি পরীক্ষার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও পরীক্ষা নেওয়ার কার্যক্রম শুরু করবে এই কর্তৃপক্ষ। এই কর্তৃপক্ষ সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু এইচএসসির ফল প্রকাশের পরও এই অধ্যাদেশ হয়নি এবং কর্তৃপক্ষও গঠন হয়নি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির উচ্চপর্যায়ের সূত্রগুলো বলছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ চান আসন্ন শিক্ষাবর্ষে নতুন এ পদ্ধতি চালু না হোক। সব মিলিয়ে বাস্তবতা হলো আসন্ন শিক্ষাবর্ষে নতুন এই পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে না। এটি আজ ইউজিসির চেয়ারম্যানের রুটিন দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক আলমগীরও স্পষ্ট করলেন।
ভর্তিতে পোষ্য কোটা বাদ চান ইউজিসি চেয়ারম্যান
এ বিষয়ে অধ্যাপক আলমগীর আরও বলেন, রাষ্ট্রপতির অভিপ্রায় অনুসারে ইউজিসি সব বিশ্ববিদ্যালয়কে একক আওতাভুক্ত করে একটি ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছিল। এ বিষয়ে কমিটি গঠন করে এবং বিস্তারিত আলোচনা শেষে একটি অধ্যাদেশের খসড়াও তৈরি করেছিল। কিন্তু অনিবার্যকারণে আসন্ন শিক্ষাবর্ষ থেকে একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে গত বছরের মতো আসন্ন শিক্ষাবর্ষেও গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
অধ্যাপক আলমগীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও এ বছর গুচ্ছভুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গুচ্ছে ভর্তিতে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দিয়ে নজির স্থাপনেরও পরামর্শ দেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ‘পোষ্য কোটা’ রাখা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন অধ্যাপক আলমগীর। এ বিষয়ে তিনি বলেন, এ বছর এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৯২ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬০ হাজারের বেশি আসন রয়েছে। এই শিক্ষার্থীরা তাঁদের কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয়ে ভর্তি হতে পারবেন না। এ রকম পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তিতে পোষ্য কোটা রাখার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পোষ্য কোটা থেকে বের হয়ে আসার পরামর্শ দেন।