সুষ্ঠু হওয়া মূল্যায়নে সমস্যার কথা জানালেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা
ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন কার্যক্রমের গতকাল সোমবার ছিল চতুর্থ দিন। এদিন ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, সপ্তম শ্রেণির গণিত, অষ্ঠম শ্রেণির বাংলা ও নবম শ্রেণির ধর্ম বিষয়ে মূল্যায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন হয়।
গতকাল ঢাকার একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বেশ আনন্দের সঙ্গেই এসব মূল্যায়নে অংশ নিচ্ছে। মূল্যায়নের মাঝখানে বিরতিতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা জানান মূল্যায়ন সুষ্ঠু হচ্ছে। বহুতল ভবনের বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে গিয়ে দেখা যায়, কোনো কক্ষে শিক্ষার্থীরা লিখিত অংশের জন্য খাতায় মনোযোগ দিয়ে লিখছে আবার কোনো কক্ষে দলগতভাবে আলোচনা করছে এবং প্রাপ্ত তথ্য রঙিন কাগজে পোস্টার আকারে লিখছে এবং একই সঙ্গে সেগুলোর বিশদ বিবরণ নিজেদের প্রত্যেকের খাতায় লিখছে। এ মূল্যায়নে প্রতিটি শ্রেণির প্রতিটি বিষয়েই শিক্ষার্থীদের একক, জোড়ায় ও দলগত কাজে অংশ নিতে হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে মূল্যায়ন নিয়ে যেমন আনন্দ দেখা গেছে, তেমনি বেশ কিছু সমস্যার কথাও তারা বলছে। কয়েকজন অভিভাবকও করলেন বেশ কিছু অভিযোগ।
১. প্রশ্নপত্র ফাঁস, সঙ্গে মিলছে সমাধানও
একাধিক শ্রেণির বেশ কিছু শিক্ষার্থী জানায়, মূল্যায়ন কার্যক্রমের নির্দেশিকা (প্রশ্নপত্র) অনলাইনে বিভিন্ন মাধ্যমে বিশেষ করে ইউটিউবে সমাধানসহ পাওয়া যাচ্ছে, ফলে শিক্ষার্থীরা আর মূল বই পড়া কিংবা মূল্যায়ন চলাকালীন একক, জোড়ায় ও দলীয় কার্যক্রমের সময় নিজস্ব চিন্তাভাবনা কিংবা পারস্পরিক আলোচনা না করেই অনলাইনে পাওয়া সমাধান খাতায় ও নির্ধারিত পোস্টারে লিখে জমা দিচ্ছে। সব শিক্ষার্থী এমনটা না করলেও একই শ্রেণিতে কিছু শিক্ষার্থী যখন এটা করছে, তখন বাকিরা কষ্ট করে পাঠ্যবই পড়ে এবং নিজেদের মধ্যে আলোচনা ও সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সমাধান বের করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা বলছে যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গেলেও তাদের জন্য কোনো সমস্যা ছিল না, কিন্তু প্রশ্নের উত্তর কিংবা সমাধান অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ার ফলে ভালো শিক্ষার্থীরাও কষ্ট করে পড়ে, মাথা খাটিয়ে সমাধান বের করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
এক শিক্ষার্থী আক্ষেপের সুরে জানায়, ‘সত্যি বলতে আজ আমাদের বাংলা পরীক্ষা (মূল্যায়ন) ছিল। কিন্তু আমি বই থেকে কিচ্ছু শিখিনি। মুখস্থ লেখাপড়া করছি ইউটিউব থেকে।’ আশপাশে থাকা আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী হাসিমুখে এ কথায় সম্মতি জানায় যে তারাও ইউটিউব থেকেই প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে লিখে এসেছে খাতায়।
"আমি নিজেও একসময় শিক্ষকতা করেছি, কিন্তু আমার ছোট ছেলেটা যেভাবে মুঠোফোনের দিকে ঝুঁকছে, আমার তো মনে হয় না, এতে কোনো পড়াশোনা হচ্ছে"নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাবেক কলেজ শিক্ষক
২. প্রশ্ন বুঝতেই সময় চলে যায়
ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বেশ কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় মূল্যায়ন নির্দেশিকা (প্রশ্নপত্র) যা তাদের দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো তারা ভালোভাবে বুঝতে পারছে না। প্রশ্নেপত্রে ঠিক কী চাওয়া হচ্ছে, তা বুঝতেই তাদের সময় চলে যাচ্ছে। অনেক সময় প্রশ্নপত্র ভালোভাবে না বুঝেই তাদের উত্তর করতে হচ্ছে। তারা জানায়, এ ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্রের ভাষা আরও সহজ হলে তাদের পরীক্ষা আরও সুন্দর হতো।
৩. লিখিত অংশের দক্ষতার জন্য কিছু কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন থাকলে ভালো
অষ্টম শ্রেণির কিছু শিক্ষার্থী জানায়, তাদের হাতের লেখার দক্ষতা ঠিকঠাক অর্জিত হচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে তারা জানায়, আগে যেমন একটি নির্দিষ্ট সময়ে কতগুলো সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর লেখার জন্য একটা চাপ কিংবা তাগিদ থাকায় হাতের লেখার দক্ষতার একটা ব্যাপার থাকত। কিন্তু এখন পরীক্ষার সময় বেশি পাওয়া যাচ্ছে এবং সুনির্দিষ্ট কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন না থাকায় তাদের লিখে উত্তর করার সময় হাতের লেখার দক্ষতার জায়গাটুকু হারিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কম সময়ের মধ্যে কিছু কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নের উত্তর করতে দিলে তাদের হাতের লেখার দক্ষতা অর্জিত হতো।
৪. সন্তানের মুঠোফোনে ঝুঁকে পড়া রোধে নির্দেশিকা জরুরি
কয়েকজন অভিভাবক সন্তানদের মুঠোফোনের দিকে ঝুঁকে পড়া নিয়ে কিছুটা চিন্তিত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক অভিভাবক, যিনি নিজেই সাবেক কলেজশিক্ষক, তিনি বলেন, ‘বাচ্চা তো পড়েই না। আমার বড় ছেলে নটর ডেম থেকে পাস করে বাইরে পড়াশোনা করছে। ওকে আমিই পড়িয়েছি। ওর মধ্যে অনেক সিরিয়াসনেস ছিল। কিন্তু ছোট ছেলে এবার ষষ্ঠ শ্রেণির মূল্যায়ন দিচ্ছে, ওকে তো পড়াতেই পারছি না। পড়াশোনা নিয়ে একেবারেই সিরিয়াস না। যতটুকু সময় পড়তে বসাই, ঘুরেফিরে মুঠোফোনের দিকেই ঝুঁকে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলেই বলছে, পড়াশোনা তো সব অনলাইনে, ইউটিউবে। আমি নিজেও একসময় শিক্ষকতা করেছি, কিন্তু আমার ছোট ছেলেটা যেভাবে মুঠোফোনের দিকে ঝুঁকছে, আমার তো মনে হয় না, এতে কোনো পড়াশোনা হচ্ছে।’
বিষয়টি নিয়ে স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছেন কি না, এমন প্রশ্ন করা হলে সাবেক কলেজশিক্ষক বলেন, ‘শিক্ষকদের সঙ্গে তো কথা বলেছি। কিন্তু তাঁরা বলছেন, “আপনার বাচ্চা তো ক্লাসে রেসপন্স করছে, শিখছে; ঠিকই আছে।”’ শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে নিচের ক্লাসের শিশুদের মুঠোফোনের ব্যবহার নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। শিক্ষার্থীদের জন্য মুঠোফোনের ব্যবহারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিষয় উল্লেখ করে আলাদা নির্দেশিকা তৈরি করলে ভালো হতো বলে জানান তিনি।
ঢাকার এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সকালের শিফটে নবম শ্রেণির ধর্ম বিষয়ে মূল্যায়ন কার্যক্রম শুরু হয়ে শেষ হয়েছে দুপুর প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ। বেলা দেড়টা থেকে শুরু হওয়া ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির মূল্যায়ন চলে বিকেল প্রায় সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত। তবে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের মূল্যায়ন নির্দেশিকায় (প্রশ্নপত্রে) উল্লেখ করা সময় এবং একই শ্রেণিতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থী থাকায় নির্দেশনা অনুসরণ করে সমতাকরণের জন্য শিক্ষার্থীর প্রয়োজন অনুসারে মূল্যায়নের মোট সময় শ্রেণিভেদে কম–বেশি করা হচ্ছে বলে জানান প্রত্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্বরত একাধিক শিক্ষক।
প্রতিটি কক্ষে প্রায় ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন প্রত্যবেক্ষক দায়িত্ব পালন করছেন। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলা এই মূল্যায়ন কার্যক্রমের মাঝখানে থাকছে বিরতি। বিরতিতে শিক্ষার্থীরা পরবর্তী সেশনের মূল্যায়নের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারছে, কেউ কেউ টিফিন খেয়ে নিচ্ছে এবং নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে পারছে। মূল্যায়নপ্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে বলে জানান সেখানকার শিক্ষকেরা।
বিদ্যালয়টির ষষ্ঠ শ্রেণির একটি কক্ষে গিয়ে দেখা গেল, বিরতির সময় হতেই প্রত্যবেক্ষক সবার লিখিত অংশের খাতা জমা নিয়ে নিলেন। তিনি জানালেন যে বিরতির পর আবার শিক্ষার্থীদের খাতা ফিরিয়ে দেওয়া হবে লিখিত অংশের বাকি প্রশ্নগুলো লেখার জন্য।
শিক্ষার্থীরা গতকালের ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বিষয়ের মূল্যায়নের জন্য নির্দেশনা অনুসারে পাঠ্যবই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। বিরতিতে একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে পাঠ্যবই হয়ে উঠেছে শিক্ষার্থীর ‘ওয়ার্ক বুক’ তথা কার্যবিবরণী। একজন শিক্ষার্থী ছয় মাসে শ্রেণিকক্ষের নিয়মিত পাঠ কার্যক্রমে কী শিখছে, তার একটা ধারণা পাওয়া যাচ্ছে তার সংশ্লিষ্ঠ পাঠ্যবই দেখেই।
শিক্ষকেরা বলছেন, পাঠ্যবইয়ের ভেতরই ছক, শূন্য স্থান, ইনফোগ্রাফের মতো অংশ শিক্ষার্থীর নিজেরই লিখে অথবা পূরণ করার সুযোগ থাকায় শিক্ষার্থীরা তথ্য জানা, বোঝা ও তথ্য উপস্থাপনের প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারছে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীর পাঠ্যবইটি কতটুকু কাজে লাগছে, তার একটা হিসাব শিক্ষার্থীর নিজের কাছেই থাকছে।
এর আগে গত ৩ জুলাই সারাদেশে একযোগে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির এই ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন শুরু হয়। যা শেষ হবে আগামী ৩ আগস্ট। অভিন্ন দশটি বিষয়ের প্রতিটিতেই একইভাবে মূল্যায়ন কার্যক্রম চলবে। বার্ষিক মূল্যায়ন তথা বার্ষিক পরীক্ষার আগেই চিহ্নিত সমস্যাগুলো সমাধান করে আরও সুন্দর মূল্যায়নব্যবস্থার আয়োজন করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সচেষ্ট হবে, এমনটাই প্রত্যাশা করছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা।