পটুয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিধি ভেঙে নিয়োগ–পদোন্নতি, অর্থ ফেরতের তাগিদ
এভাবে বিধিবহির্ভূতভাবে গ্রেড ও পদোন্নয়ন আর্থিক ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলা পরিপন্থী।
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনাকালেও অনিয়মের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছিল ইউজিসি।
মো. কবির সিকদার ২০০৬ সালে কম্পিউটার অপারেটর পদে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি ও এইচএসসিতে দ্বিতীয় বিভাগ। আর বিকমে তৃতীয় শ্রেণি। তবে শিক্ষাগত জীবনে তৃতীয় শ্রেণি তাঁর পদোন্নতি আটকাতে পারেনি। একবার নয়, তিনবার পদোন্নতি পেয়ে এখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বলছে, বিধিবহির্ভূতভাবে এটি করা হয়েছে। আরও সাতজন সহকারী রেজিস্ট্রারের ক্ষেত্রে একই ধরনের অনিয়ম দেখতে পেয়েছে ইউজিসি। আর এভাবে বিধিবহির্ভূতভাবে গ্রেড ও পদোন্নতি আর্থিক ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলা পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেছে দেশের উচ্চশিক্ষা দেখভালের দায়িত্বে থাকা সংস্থাটি।
এখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সরকারি বিধিবিধান মেনে এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।অধ্যাপক মো. আবু তাহের, ইউজিসির সদ্য সাবেক সদস্য, নতুন উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
এ জন্য বিধিবহির্ভূতভাবে দেওয়া ইনক্রিমেন্ট, গ্রেড ও পদোন্নতি বাতিল করে আবার পে-ফিক্সেশন (বেতনকাঠামো সমন্বয়) করে বেতন স্কেল ও পদ নির্ধারণ করে অতিরিক্ত টাকা দায়ী বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে আদায় করে ইউজিসিকে জানাতে বলা হয়েছে।
তবে অনিয়মের ঘটনা কেবল এগুলোই নয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রেই অনিয়ম করে আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে বলে ইউজিসির চোখে ধরা পড়েছে। ১০ থেকে ১১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩–২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট পর্যালোচনা করতে গিয়ে আর্থিক এসব অনিয়মের ঘটনাগুলো দেখতে পায় ইউজিসি। বাজেটসংক্রান্ত এসব আপত্তির কথা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। ইউজিসি সূত্র জানিয়েছে, তারা এসব পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার জবাব দেবে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রার সন্তোষ কুমার বোস প্রথম আলোকে বলেন, ইউজিসি খসড়া আকারে আপত্তির কথা জানিয়েছে। এটি চূড়ান্ত নয়। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব পরিচালক তাদের (ইউজিসি) সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন।
বাজেটসংক্রান্ত ওই সব আপত্তির বাইরেও পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক অনুমোদন ছাড়াই নিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ভঙ্গ করে ও পদবিহীন নিয়োগ এবং সংশ্লিষ্ট পদে আবেদন না করেও নিয়োগের অভিযোগ তদন্ত করছে ইউজিসি। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এই অভিযোগপত্র দিয়েছিল। তার ভিত্তিতে ইউজিসির সচিব ফেরদৌস জামানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি তদন্ত করছে। ফেরদৌস জামান প্রথম আলোকে বলেন, এখন তাঁরা তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির কাজ করছেন।
ইউজিসি বলছে, নিয়ম ভেঙে ৮ জন সহকারী রেজিস্ট্রারের পদোন্নতি। ৫৭ জনকে জনবলকাঠামোর বাইরে নিয়োগ।
ইউজিসির বাজেট পর্যালোচনাসংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, কবির সিকদার ছাড়াও আরও যে সাতজনকে অনিয়ম করে গ্রেড ও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তাঁরা হলেন প্রকৌশল বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার মুহা. মাসুম বিল্লাহ, এএনএসভিএম অনুষদের সহকারী রেজিস্ট্রার মো. জাহাঙ্গীর কবির, পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও ওয়ার্কার্স বিভাগের মো. জিয়াউদ্দিন, শের-ই–বাংলা হলের সহকারী রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা অনুষদের মো. মুনীরুজ্জামান, অর্থ ও হিসাব বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ মহসিন ও মুহাম্মদ মাহবুব আলম।
জানতে চাইলে মো. কবির সিকদার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, রিজেন্ট বোর্ডের (সিন্ডিকেটকে এখানে রিজেন্ট বোর্ড বলে) অনুমোদন নিয়েই তাঁরা পদোন্নতি পেয়েছেন। শুধু তিনি নন, তাঁর মতো আরও কয়েকজন আছেন। তবে তাঁরা তো আর এটি করেননি। সময় হওয়ায় তাঁরা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিলেন। এখন কর্তৃপক্ষ যা বলবে, তা মেনে নেবেন।
ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব অনিয়মের বিষয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনাকালেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল, কিন্তু কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। তাই এ বিষয়ে দ্রুত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে ইউজিসিকে জানাতে বলা হয়েছে।
জনবলকাঠামোর বাইরে ৫৭ পদে নিয়োগ
ইউজিসির বাজেট পর্যালোচনা দলের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত জনবলকাঠামোতে (অর্গানোগ্রাম) পদ না থাকা সত্ত্বেও উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, উপরেজিস্ট্রার, উপপরিচালকসহ বিভিন্ন পদে ৫৭ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ জন উপরেজিস্ট্রার রয়েছেন। সহকারী রেজিস্ট্রার আছেন ৯ জন। একইভাবে বিভিন্ন দপ্তরে ২১ জন সেকশন অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বাকিরা অন্যান্য পদে নিয়োগ পেয়েছেন।
ইউজিসি বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত বা অনিয়মিত শ্রমিক পদে নিয়োজিতদের মাঠপর্যায়ে কাজ করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তাদের বিভিন্ন দপ্তরে বা বিভাগে দায়িত্ব দিয়ে নিয়ম ভঙ্গ করা হয়েছে।
অনুমোদনহীন নিয়োগ
ইউজিসির প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়াই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ছয়জন প্রভাষক। একই কায়দায় একই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তিনজন শাখা কর্মকর্তা, একজন ‘কিচেন হেলপার’, নয়জন ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট, দুজন বুক বাইন্ডার, দুজন অ্যাটেনডেন্ট, দুজন হেলপার, দুজন মালি, একজন সুইপার, ৮ জন অফিস সহায়ক।
ইউজিসি বলেছে, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম নিয়োগের মাধ্যমে বেতন–ভাতা পরিশোধ করে নিয়মের ব্যত্যয় ও আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে। কারণ, ইউজিসির প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়া কোনো পদে নিয়োগ, পদোন্নতি বা আপগ্রেডেশনের সুযোগ নেই। এ জন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এই জনবলের জন্য বেতন-ভাতা বরাদ্দ ধরা হয়নি।
জানতে চাইলে ইউজিসির সদ্য সাবেক সদস্য অধ্যাপক মো. আবু তাহের (গত সপ্তাহে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন) প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা আর্থিক অনিয়মগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে করণীয় বিষয়ে সুপারিশও করেছেন। এখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সরকারি বিধিবিধান মেনে এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।