শিক্ষার্থী ঝরে পড়া কমেছে, ঘাটতি গুণমানে
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার বয়স হয়েছে, এমন ৯৭ ভাগের বেশি শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হারও কমে ১৪ শতাংশে নেমে এসেছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ স্তরেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
তবে উন্নতির পাশাপাশি আরেকটি বিপরীত চিত্রও আছে। সরকারি তথ্যই বলছে, এখনো মাধ্যমিকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে বেশ পিছিয়ে আছে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থীর ইংরেজিতে অবস্থা খারাপ। একই শ্রেণিতে গণিতে ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর অবস্থা খারাপ বা গড়পড়তা। প্রাথমিকেও বাংলা ও গণিতের মতো বিষয়েও কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা।
সরকারি তথ্য আরও বলছে, ইংরেজি বিষয়টি প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো হয়। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক কিংবা তার ওপরের স্তর পাস করা অনেক শিক্ষার্থীই ইংরেজিতে সাধারণ যোগাযোগও করতে পারে না।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে শিক্ষার সম্প্রসারণ হলেও গুণগত মানে এখনো বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা অনেক পিছিয়ে। এ জন্য শিক্ষার নানা স্তর পার হওয়ার পরও শিক্ষার্থীরা দক্ষতায় পিছিয়ে থাকছে। গুণগত শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষকের যেমন অভাব আছে, তেমনি দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকেরও ঘাটতি আছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় একেকটি শ্রেণিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত অনেক বেশি। এ জন্য গুণগত শিক্ষার জন্য এখনই প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে সেই বিনিয়োগ যথাযথ হয়েছে কি না, সেটিও তদারক করতে হবে।
শিক্ষা প্রশাসনের ব্যক্তিরাও গুণগত শিক্ষার কথা বলছেন। নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে গুণগত শিক্ষার কাজটি আরেক ধাপ এগিয়ে নেওয়া যাবে বলে তাঁরা আশা করছেন। যদিও নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সময় এসে দেখা যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে প্রস্তুতিতে ঘাটতি আছে।
নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর পর মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের পাঁচ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ হলেও প্রাথমিক স্তরের সাধারণ শিক্ষকদের এখনো প্রশিক্ষণ শুরুই হয়নি। গতকাল সোমবার অনলাইনে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরুর কথা। এ ছাড়া জানুয়ারি শেষ হতে যাচ্ছে। এখনো দেশের সব শিক্ষার্থী সব বই হাতে পায়নি।
চলতি বছর প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়েছে। আগামী বছর থেকে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য শ্রেণিতে নতুন এই শিক্ষাক্রম শুরু হবে।
সারা দেশে এখন প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত চার কোটির বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি ১ লাখ ১৮ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে ২ কোটি ৯০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। সরকারি-বেসরকারি প্রায় ১৯ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আছে ৮৯ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। তবে স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাধ্যমিক স্তর মিলিয়ে মাধ্যমিকে মোট শিক্ষার্থী এক কোটির বেশি। আর সরকারি-বেসরকারি ১৬১ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাতীয়, উন্মুক্ত, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৫৩টি সরকারি) পড়েন প্রায় ৪৪ লাখ ৫০ হাজার শিক্ষার্থী। মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় পড়েন আরও বিপুল শিক্ষার্থী। সরকারের তত্ত্বাবধায়নের বাইরে নিজেদের তত্ত্বাবধায়নে আছে ১৯ হাজারের বেশি কওমি মাদ্রাসা।
জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান প্রথম আলোকে বলেন, এখন গুণগত শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার মান বাড়াতে হলে প্রথমেই শিখন পরিবেশের উন্নতি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকের মর্যাদা বাড়াতে হবে।
তারিক আহসান বলেন, শিখনমানের উন্নতি বলতে, নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিখন শুধু শ্রেণিকক্ষে নয়, বাড়িতে ও চারপাশ থেকেও শেখানো হবে। তাই সার্বিকভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। শিক্ষকের মর্যাদা বলতে বেতনের সুবিধার পাশাপাশি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে তাঁদের গুরুত্ব দিতে হবে। এভাবে তাঁদের মর্যাদা বাড়ানো হলে এই পেশায় আরও মেধাবীকে আনা সম্ভব হবে, যা শিক্ষার মান বাড়াতে সহায়তা করবে। এ জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দের হার জিডিপির ৬ শতাংশে নেওয়া জরুরি।