৪১ কোটি পাঠ্যবইয়ের মধ্যে গেছে ৬ কোটি

নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে। বছরের প্রথম দিনে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা তিন থেকে চারটি বই পেয়েছে। গতকাল সকালে বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় চত্বরেছবি: সোয়েল রানা

রাজধানীর সেগুনবাগিচা হাইস্কুলে গতকাল বুধবার দুপুর ১২টার পর গিয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি দেখা যায়নি। তবে প্রধান শিক্ষক এ কে এম ওবাইদুল্লাহ অফিসেই ছিলেন। নতুন পাঠ্যবই নিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। বললেন, মাধ্যমিকে অষ্টম ও দশম শ্রেণির জন্য তিনটি করে বই পেয়েছেন। প্রাথমিকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির জন্যই এসেছে তিনটি করে বই। প্রাক্‌-প্রাথমিকে দুটি বইয়ের মধ্যে একটি করে পেয়েছেন। যেসব বই এসেছে, তা শিক্ষার্থীদের দেওয়া হচ্ছে।

সেগুনবাগিচার এই বিদ্যালয়ের ভেতরে এক পাশে রমনা থানা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়। সেখানে গিয়ে জানা গেল, এই থানা কার্যালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা মিলিয়ে ৫১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনা মূল্যে বই দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের মোট পাঠ্যবইয়ের চাহিদা ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৪৬৪টি। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত পেয়েছেন অষ্টম শ্রেণির জন্য ২২ হাজার ৭৭০টি এবং দশম শ্রেণির জন্য ২২ হাজার ৫৫৪টি। বাকি কোনো শ্রেণির বই গতকাল পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

সান্ত্বনা যে যখন বইগুলো পাবে তোমরা, আগের থেকে সুন্দর দেখাবে এবং বছরের মাঝখানে পাতাগুলো ছিঁড়ে যাবে না।
অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, শিক্ষা উপদেষ্টা

এবার বিনা মূল্যের পাঠ্যবই বিতরণের এটি একটি খণ্ডিত চিত্র। কমবেশি সারা দেশেই বছরের প্রথম দিন এমন চিত্র ছিল। ফলে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী শিক্ষাবর্ষ শুরুর প্রথম দিনে গতকাল নতুন বই পায়নি।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) হিসাবেই মোট প্রায় ৪১ কোটি পাঠ্যবইয়ের মধ্যে গত বছরের শেষ দিন মঙ্গলবার পর্যন্ত ৬ কোটি বই গেছে।

এখনই সব শিক্ষার্থীর হাতে বিনা মূল্যের সব পাঠ্যবই তুলে দিতে না পারায় শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে গতকাল ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়ের অনলাইন ভার্সনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিক্ষা উপদেষ্টা পাঠ্যবই নিয়ে কথা বলেন। এনসিটিবির ওয়েবসাইটে অনলাইন ভার্সন দেওয়া হয়েছে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) হিসাবেই মোট প্রায় ৪১ কোটি পাঠ্যবইয়ের মধ্যে গত বছরের শেষ দিন মঙ্গলবার পর্যন্ত ৬ কোটি বই গেছে।

পাঠ্যবই ছাপা ও তা শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের ছাত্রছাত্রীদের হাতে এখনই সব দিতে পারা গেল না, এ জন্য আমি তাদের অভিভাবকদের কাছে এবং তাদের কাছে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। তবে সান্ত্বনা যে যখন বইগুলো পাবে তোমরা, আগের থেকে সুন্দর দেখাবে এবং বছরের মাঝখানে পাতাগুলো ছিঁড়ে যাবে না।’

শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই প্রণয়ন এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করে এনসিটিবি। করোনাকাল ছাড়া ২০১০ সাল থেকে শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎসব করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যে বই তুলে দেওয়া হতো। তবে কোনো কোনো বছর কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয়ও হয়েছে।

তবে এবার নতুন বছরের জন্য সমস্যাটি আরও তীব্র হয়েছে। এখন যে পরিস্থিতি, তাতে জানুয়ারি পেরিয়ে ফেব্রুয়ারিতেও সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই দেওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কা আছে।

আরও পড়ুন

গতকালের অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব সিদ্দিক জোবায়ের বলেছেন, ‘আমরা সব বই নিয়ে পয়লা জানুয়ারি সব বিদ্যালয়ে পৌঁছাতে পারিনি। কিন্তু আমরা চেষ্টা করেছি প্রতিটি জেলার প্রতিটি উপজেলায় কিছু কিছু শিক্ষার্থী যেন ১ জানুয়ারি বই পায়। তবে আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, জানুয়ারি মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে চেষ্টা করছি কীভাবে সব বই পৌঁছে দেওয়া হয়।’

একই অনুষ্ঠানে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ৪১ কোটি বইয়ের মধ্যে মঙ্গলবার পর্যন্ত ৬ কোটি বই গেছে। আরও ৪ কোটি বই ট্রাকে ওঠার অপেক্ষায় আছে, বুধবারের মধ্যে হয়তো এগুলো চলে যাবে। ৫ জানুয়ারির মধ্যে প্রাথমিকের বাকি সব বই, ১০ জানুয়ারির মধ্যে মাধ্যমিকের প্রায় আটটি বই এবং ২০ জানুয়ারির মধ্যে সব বই যাবে। এ লক্ষ্যে তাঁরা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

রিয়াজুল হাসান বলেন, বছরের পর বছর জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে বই উৎসবের নামে যে অপচয় হয়েছে, সেটি লক্ষ্য রেখে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন, উৎসবের বাহুল্য বাদ দিয়ে শিক্ষাবর্ষের শুরুতে সবার কাছে গুণগত মানসম্পন্ন বই পৌঁছে দেওয়া হবে।

তবে এবার নতুন বছরের জন্য সমস্যাটি আরও তীব্র হয়েছে। এখন যে পরিস্থিতি, তাতে জানুয়ারি পেরিয়ে ফেব্রুয়ারিতেও সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই দেওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কা আছে।

দেরির কারণ

গতকালের অনুষ্ঠানে পাঠ্যবই ছাপার কাজে বিলম্বের কিছু কারণ ব্যাখ্যা করেন শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।

শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, এ বইগুলো ছাপা, এটি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের মতো অবস্থা হয়েছে। এখানে প্রথমত হলো বিদেশে বই ছাপানো হবে না। অনিবার্য কারণে শিক্ষাক্রমও পরিবর্তন করা হয়েছে, এতে বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে। যে সময় থেকে এই কাজ শুরু করা হয়েছে, তখন সময়ও খুব কম ছিল। তার মধ্যে আবার অনেক বই পরিমার্জন করতে হয়েছে; যাতে দলীয় রাজনীতি নিরপেক্ষভাবে যেন বইয়ে থাকে। তারপর আবার উন্নত মানের ছাপা, উন্নত মানের কাগজ, উন্নত মানের মলাটের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। আরেকটি বড় সমস্যা হলো এনটিসিবিতে যাতে এত দিন ধরে কাজ করেছেন, তাঁদের অনেককে অনিবার্য কারণে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরে আগে অভিজ্ঞতা ছিল এমন মানুষদেরই বসানো হয়েছে। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে মুদ্রণশিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কীভাবে বোঝাপড়া করতে হয়, এটি তাঁদের অভিজ্ঞতায় নেই।

আরও পড়ুন