আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে বাড়ছে লাল-সবুজের পতাকাবাহী জাহাজ
বিশ্বজুড়ে জাহাজ পরিচালনা ব্যবসায় এখন দুঃসময়। করোনার প্রভাবে পণ্য পরিবহন কমে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক অনেক শিপিং কোম্পানিই নিজেদের বহরে থাকা ভাড়ায় চালিত জাহাজ ছেড়ে দিচ্ছে। আর ঠিক এমন সময়ে দেশের বহরে যুক্ত হচ্ছে সমুদ্রগামী জাহাজ। তাতে আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে বাড়ছে লাল–সবুজের পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা।
দেশের বহরে যুক্ত হওয়া জাহাজের সিংহভাগই সাধারণ পণ্য পরিবহনকারী মধ্যম আকারের বা ‘সুপরাম্যাক্স’ জাহাজ। সামান্য সংখ্যক তেল পরিবহনকারী জাহাজ (ট্যাংকার) ও কনটেইনার পরিবহনকারী ফিডার ভেসেল বা মাঝারি আকারের জাহাজ রয়েছে। দেশে এসব জাহাজ তৈরি হয় না। আবার নতুন জাহাজেরও দাম অনেক বেশি। ফলে বিদেশ থেকেই ১৫–২০ বছরের পুরোনো জাহাজই আমদানি করে পণ্য পরিবহনে যুক্ত করেন উদ্যোক্তারা। প্রায় ৫০–৬০ হাজার টন পণ্য পরিবহন ক্ষমতার ‘সুপরাম্যাক্স’ আকারের একেকটি জাহাজের দাম পড়ে বয়সভেদে ১২০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন ব্যবসার জন্য কোনো জাহাজ আমদানি হয়নি। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে আমদানি হয়েছে আটটি জাহাজ। এসব জাহাজ পৌনে ৪ লাখ টন পণ্য পরিবহনে সক্ষম। আমদানি হওয়া এসব জাহাজের নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছেন জাহাজমালিকেরা। করোনার সময় আমদানি হওয়া জাহাজের স্থায়ী নিবন্ধন হয়েছে কয়েকটির। বাকিগুলো নিবন্ধনের অপেক্ষায় আছে।
বিনিয়োগ বাড়ছে কেন?
এ খাতের বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সমুদ্রগামী জাহাজ ব্যবসায় সরকারের শুল্ককর সুবিধাসহ নীতিসহায়তাও এখন আগের তুলনায় বেশি। দেশে নিবন্ধিত জাহাজের স্বার্থ সুরক্ষা করে গত বছর নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আবার করোনার কারণে বিশ্বজুড়ে জাহাজের দাম বেশ কমে গেছে। এই দুই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের ব্যবসায়ীরা এ সময়ে এ খাতে বিনিয়োগ করছেন। পণ্য পরিবহনে ভাড়া কমে গেলেও সংকট কেটে গেলে যাতে সুযোগ নেওয়া যায় সে জন্য এই সংকটের সময়কে বিনিয়োগের সুযোগ হিসেবে বেছে নিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সমুদ্রগামী জাহাজ মালিক সমিতির সহসভাপতি ও মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, সেবাশিল্প হিসেবে এই খাতে সরকারের নীতিসহায়তা আগের চেয়ে বেশি। এতে করোনার সময় জাহাজ নিবন্ধন বেড়েছে। তবে কেনার পর পাঁচ বছরের মধ্যে বিক্রি করা যাবে না এমন অঙ্গীকার তুলে দেওয়াসহ আরও কিছু নীতিসহায়তা দেওয়া হলে এই খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়বে।
মোস্তফা কামাল মনে করেন, এই খাতে বিনিয়োগ হলে দেশীয় নাবিকদের কর্মসংস্থান বাড়বে। পণ্য পরিবহন বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও বাড়বে। আবার নিজেদের পণ্য পরিবহন করেও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা যাবে।
>করোনার এ সময়ে এ খাতে দেশের বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী বিনিয়োগ করেছে ৯০৪ কোটি টাকা।
এ খাতের উদ্যোক্তারা জানান, বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো শুরুতে নিজেদের পণ্য পরিবহনের জন্য জাহাজ পরিচালনা ব্যবসা শুরু করে। বিভিন্ন শিল্পগ্রুপের পণ্য আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পণ্য পরিবহনকারী জাহাজেও বিনিয়োগ বাড়ছে। নিজেদের পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবেও প্রতিযোগিতায় নেমেছেন এ দেশের জাহাজমালিকেরা। যেমন কেএসআরএমের মতো গ্রুপ সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য নিজেদের বহরে জাহাজের সংখ্যা বাড়াচ্ছে।
জাহাজের নিবন্ধন প্রদানকারী সংস্থা নৌবাণিজ্য কার্যালয়ের মুখ্য কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সমুদ্রগামী জাহাজশিল্পে এক বছরে সরকার অনেক সুযোগ–সুবিধা দিয়েছে। বড় জাহাজ আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে। দেশীয় জাহাজ বন্দরের জেটিতে ভেড়ানোর ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার রয়েছে। গত বছর দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজে ৫০ শতাংশ পণ্য পরিবহনের বাধ্যবাধকতা রেখে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে উদ্যোক্তারাও এগিয়ে এসেছেন। এখন জাহাজের সংখ্যা বেড়ে ৫৬টিতে উন্নীত হয়েছে। আবার নিবন্ধনের অপেক্ষায় রয়েছে আটটি জাহাজ।
করোনাকালে বিনিয়োগ যাদের
দেশে এখন পণ্যবাহী সমুদ্রগামী সবচেয়ে বেশি জাহাজ রয়েছে কেএসআরএম গ্রুপের হাতে। প্রতিষ্ঠানটি করোনার সময়ও দুটি সুপরাম্যাক্স আকারের সাধারণ পণ্য পরিবহনের জাহাজের নিবন্ধন নিয়েছে। এর মধ্যে একটি এনেছে করোনার সময়। আরেকটি গত বছরের শেষে আমদানি করে তারা। এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বহরে জাহাজের সংখ্যা ২১টিতে উন্নীত হয়েছে। ২০০৫ সালে এই বৈশ্বিক ব্যবসায় নেমে গ্রুপটি এখন নেতৃত্ব দিচ্ছে সমুদ্রগামী জাহাজশিল্পে।
জানতে চাইলে কেএসআরএম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, সমুদ্রগামী জাহাজশিল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে সুবিধা বেড়েছে। আবার বিশ্ববাজারে সমুদ্রগামী পুরোনো জাহাজের দর এখন ক্রেতার পক্ষে। বিনিয়োগ বাড়ার কারণ এটি। কেএসআরএম গ্রুপ ব্যবসা সম্প্রসারণের প্রয়োজনে সংকটের সময়ও জাহাজ কিনছে। সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন ভাড়া বাড়লে ব্যবসার সুযোগও বাড়বে।
দেশে এক দশক ধরে লাল–সবুজের পতাকাবাহী কোনো সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ ছিল না। দুটি প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে কনটেইনার জাহাজে পণ্য পরিবহনের ব্যবসা শুরু হলেও এক দশক আগে সরে যায় তারা। এই খরা কাটিয়ে করোনার সময় ১১৬ কোটি টাকায় দুটি কনটেইনার জাহাজ কিনে এই খাতে ব্যবসা শুরু করেছে কর্ণফুলী লিমিটেড। জাহাজ দুটি এখন চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং পথে কনটেইনার পরিবহন করছে। প্রতিটি জাহাজ ১ হাজার ৫৫০ একক কনটেইনার পরিবহনে সক্ষম।
করোনার সময় এমন বিনিয়োগ নিয়ে জানতে চাইলে কর্ণফুলী লিমিটেডের পরিচালক হামদান হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেকোনো সংকটের সঙ্গে সুযোগও থাকে। এ কারণে করোনার বিষয় মাথায় রেখেই কনটেইনার জাহাজে বিনিয়োগ করেছি।’
কেএসআরএম গ্রুপের পর সমুদ্রগামী জাহাজশিল্পে (বাল্ক ভেসেল) দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে আছে আকিজ গ্রুপ। আকিজ গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আকিজ মেরিটাইম লিমিটেড করোনার সময় দুটি সমুদ্রগামী জাহাজ আমদানি করেছে। আকিজ শিপিং লাইন লিমিটেড এসব জাহাজ পরিচালনা করছে। আকিজ শিপিং লাইন লিমিটেডের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, নিবন্ধনের অপেক্ষায় থাকা দুটিসহ তাদের বহরে রয়েছে ১০টি জাহাজ।
এ ছাড়া মেঘনা গ্রুপ দুটি জাহাজ আমদানি করেছে। এসব গ্রুপের বাইরে ভ্যানগার্ড মেরিটাইম লিমিটেড একটি জাহাজ এনেছে। নিজেদের আমদানি পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি বিদেশে এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরে পণ্য পরিবহন করছে এসব জাহাজ।
বিশ্ববাজারে দুঃসময়
বিশ্বজুড়ে এক থেকে অন্য দেশ, এক বন্দর থেকে অন্য বন্দরে যত পণ্য পরিবহন হয় তার ৯০ শতাংশই জাহাজে পরিবাহিত হয়। করোনার প্রভাবে জাহাজে পণ্য পরিবহন কিছুটা কমে গেছে। কারণ শিল্পের কাঁচামালসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি–রপ্তানি কমেছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে পাঁচ–দশ–বিশ বছরের পুরোনো জাহাজের দামও কিছুটা কমে গেছে।
গ্রিসভিত্তিক জাহাজ বেচাকেনা ও বাজার গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ইন্টারমোডাল শিপব্রোকার্স গত সপ্তাহের প্রতিবেদনে বলেছে, পাঁচ বছরের পুরোনো ‘সুপরাম্যাক্স’ আকারের জাহাজ এখন বিশ্ববাজারে বেচাকেনা হচ্ছে গড়ে ১৫ মিলিয়ন ডলারে (বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ১২৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা)। ২০১৯ সালের একই সময়ে এ দাম ছিল ১৬ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার (১৩৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা)। ২০১৮ সালে ছিল ১৮ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার (১৫৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা)। জাহাজের বয়স যত বেশি হয় দামও তত কমে যায়।
এগিয়ে বেসরকারি খাত
বাংলাদেশে তিন দশক আগে সরকারি খাত এগিয়ে থাকলেও এখন বেসরকারি খাতই এই সেবাশিল্পে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সরকারি খাতে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন ১৯৭২ সালের জুনে ‘এমভি বাংলার দূত’ জাহাজে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন ব্যবসার যাত্রা শুরু করে। ১৯৮২ সালের মধ্যে ২৭টি জাহাজ যোগ হয় এই সংস্থার বহরে। পর্যায়ক্রমে এই সংখ্যা ৩৮টিতে উন্নীত হয়। তবে ১৯৯১ সালের পর এই সংস্থার বহরে নতুন কোনো জাহাজ যুক্ত হয়নি। উল্টো জাহাজের সংখ্যা কমে একপর্যায়ে দুটিতে নেমে আসে। এরপর সংস্থাটি গত দেড় বছরের মধ্যে ১ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকায় ছয়টি নতুন জাহাজ সংগ্রহ করেছে।
সরকারি খাতের চেয়ে এই সেবাশিল্পে বেসরকারি খাতের বয়স কম। তা–ও ৪৩ বছর। ১৯৭৮ সালে প্রায় ১০ হাজার টন ধারণক্ষমতার ‘এমভি আল সালমা’ জাহাজ নিবন্ধনের মাধ্যমে বেসরকারি খাতে এই ব্যবসার যাত্রা শুরু হয়। অ্যাটলাস শিপিং লাইনস লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সানাউল্লাহ চৌধুরী বেসরকারি খাতে এই শিল্পের পথিকৃৎ। তবে দুই দশক আগে প্রতিষ্ঠানটি সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনা শিল্প থেকে সরে আসে। এই উদ্যোক্তার দেখানো পথ ধরে এখন যুক্ত হচ্ছে বড় বড় শিল্পগ্রুপ।
নৌবাণিজ্য কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশীয় বহরে সবচেয়ে বেশি জাহাজ ছিল ২০১২ সালের জুন মাসে। সে সময় নিবন্ধিত জাহাজের তালিকায় ছিল ৬৮টি। তবে এই সংখ্যা বেশি দিন থাকেনি। জাহাজ ব্যবসায় মন্দার কারণে পরের দুই বছরে তা ৪০টিতে নেমে আসে। গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে এই সংখ্যা বাড়তে শুরু করে আবার। করোনাকালে কার্যত চাঙা হয়ে উঠছে। কর্মসংস্থান, রপ্তানি আয়, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় ও দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি—এ চারটি অর্জনও যোগ হচ্ছে এই একটি খাত থেকেই।