অব্যবস্থাপনায় ডুবেছে সরকারি পাটকল
সব মিলিয়ে সরকারি পাট খাতের পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ এখন প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী শ্রমিককে স্বেচ্ছা অবসরে (গোল্ডেন হ্যান্ডশেক) পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করে ১ জুলাই পাটকল বন্ধ করা হয়েছে।
হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসানের পেছনে কয়েক যুগের পুরোনো মেশিনের কম উৎপাদনশীলতা, সময়মতো সুলভ মূল্যে না কিনে পরে বেশি দামে কাঁচা পাট ক্রয়, বছরের পর বছর একই পণ্য উৎপাদন এবং শ্রমিকের বাড়তি মজুরি তো আছেই। অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে পরিচালনায় যুক্ত বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) কর্মচারীদের অদক্ষতা। দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে। আর আছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ।
ব্যবসার কোনো রকম অভিজ্ঞতা না থাকলেও আমলাদের দিয়েই বিজেএমসি পরিচালনা করছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। করপোরেশনের পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন চেয়ারম্যানসহ সাতজন। তাঁদের প্রত্যেকেই সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মচারী। পাটকলের ব্যবসা পুরোপুরি বোঝার আগেই বদলির ঘটনাও ঘটেছে। গত তিন বছরে দায়িত্বে ছিলেন তিনজন চেয়ারম্যান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজেএমসির সাবেক এক চেয়ারম্যান এই প্রতিবেদককে বলেন, অব্যবস্থাপনার কারণেই সরকারের পাটকল ডুবেছে। আমলাদের দিয়ে পরিচালনা করায় বিজেএমসিতে করপোরেট সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতা ছিল অতিরিক্ত মাত্রায়। কাগজ-কলমে উৎপাদন ও বিপণনের পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবে তার কিছুই ছিল না। তা ছাড়া পাট ক্রয় ও নিয়োগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে লোকসানের গোলকধাঁধা থেকে বেরোনো ছিল অসম্ভব। তিনি জানান, তাঁর দায়িত্বের সময়কালে যাঁরা পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশের পড়াশোনা ছিল বাংলা ও ইতিহাসে।
বিজেএমসির ওপর পুরো ব্যর্থতার দায় চাপিয়েছেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। জরুরি এক সংবাদ সম্মেলনে গত শুক্রবার তিনি বলেন, বিজেএমসি উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে কম দামে পাট বিক্রি করায় ভারত অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে। ফলে দেশটিতে বেশি পাট রপ্তানি করা যায়নি। ১০০ টাকা উৎপাদন খরচ হলেও বিজেএমসি তা ৭০ টাকায় বিক্রি করে। ৩০ টাকার জন্য স্থানীয় শিল্পও ক্ষতির শিকার। আবার এই ৩০ টাকা রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে ব্যয় হয়।
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ রাষ্ট্রপতির এক আদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন, পরিত্যক্ত ও সাবেক ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের ৭৮টি পাটকল নিয়ে বিজেএমসি গঠিত হয়। ১৯৮১ সালে মিলের সংখ্যা বেড়ে হয় ৮২। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের সময় ৩৫টি পাটকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। আটটি পাটকলের পুঁজি প্রত্যাহার করা হয়।
১৯৯০ সালের পর বিশ্বব্যাংকের পাট খাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় ১১টি পাটকল বন্ধ, বিক্রি ও একীভূত করা হয়। ২০০২ সালের জুনে বন্ধ হয় আদমজী জুট মিল। বর্তমানে বিজেএমসির আওতায় ২৬টি পাটকলের মধ্যে গত সপ্তাহ পর্যন্ত চালু ছিল ২৫টি। এর মধ্যে ২২টি পাটকল ও ৩টি নন-জুট কারখানা।
সরকারের চেষ্টা, সরকারের দায়
নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার মেনে বর্তমান মহাজোট সরকার ২০০৯ ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল লাভজনক করতে কর্মপরিকল্পনা করে। বকেয়া মজুরি ও দায়দেনা শোধের জন্য ৫ হাজার ২৪১ কোটি টাকা দেয় সরকার। দুই বছরের মধ্যে বন্ধ থাকা দুটি পাটকল চালু করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে চালু হয় আরও তিনটি, যা বেসরকারি খাত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।
সরকারের পাটকলগুলো ১৯৪৯ থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। সে সময় যেসব যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছিল, তা দিয়েই চালানো হচ্ছিল। ফলে উৎপাদনশীলতা অর্ধেকে নেমে আসে। ২০০৯ সালে পাটকল লাভজনক করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও যন্ত্রপাতি আধুনিকায়নে নজর দেওয়া হয়নি। এমনকি যে বিজেএমসিকে নিয়ে বর্তমানে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে, সেখানেও সংস্কারের কোনো হাত পড়েনি। ফলে লোকসানের গল্পের পুনরাবৃত্তি হয়েছে।
২০১০-১১ অর্থবছরেই কেবল একবার সরকারি পাটকলগুলো ১৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা মুনাফা করে। পরের বছরই ৬৬ কোটি টাকা লোকসান করে। তারপর ধারাবাহিকভাবে লোকসান বেড়েছে। এর মধ্যে সব মিলিয়ে গত ১০ বছরেই ৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল।
দেরিতে হলেও পাটকলের আধুনিকায়নে একটা উদ্যোগ নিয়েছিল অবশ্য বিজেএমসি। সেখানেও ছিল গলদ। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইউএমসি, জেজেআই ও গালফা হাবিব—এই তিন মিল বিএমআরই করার জন্য ১৭৩ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়। একনেকে পাসের পর গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আড়াই কোটি টাকা ছাড় করা হলেও পুরোটা ব্যয় করতে পারেনি করপোরেশন। ৩৭ লাখ টাকা ফেরত যায় সরকারের কোষাগারে। এরপর ২২টি পাটকল বিএমআরই করার জন্য চীনা সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা এগোলেও শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি।
প্রয়াত বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে তোষা পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন হয়েছিল ২০১০ সালে। সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি চাষ হওয়া পাটের দুটি প্রধান জাতের মধ্যে একটি হচ্ছে তোষা। মাকসুদুল আলমের দল ২০১২ সালে পাটের জন্য ক্ষতিকর একধরনের ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন করায় উন্নত পাটের জাত উদ্ভাবনের দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। পরবর্তী সময়ে সেই বিজ্ঞানীর নেতৃত্বেই আরেকটি জাত দেশি বা সাদা পাটের জীবনরহস্য উন্মোচিত হয়। এসব সাফল্য পাট খাতের পুনর্জাগরণের সহায়তা করবে বলে সরকারের তরফ থেকে বেশ ঢাকঢোল পেটানো হয়েছিল। তবে আদতে তেমন কিছু হয়নি।
বিজেএমসির আরেক সাবেক চেয়ারম্যান প্রথম আলোকে বলেন, বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে শ্রমিকেরা যেন আন্দোলন না করেন, সে জন্য সরকার অর্থসহায়তা দিয়ে আসছিল। তবে লোকসান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কোনো আর্থিক সহায়তা পাওয়া যায়নি। অনেকটা যেমন খুশি তেমন চলেছে সরকারের পাটকল।
শ্রমিকের ঘাড়ে দোষ
লোকসানের জন্য বরাবরই শ্রমিকের বাড়তি মজুরির অজুহাতকে বড় করে দেখিয়ে আসছেন বিজেএমসির কর্তারা। পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় গত সপ্তাহে বলেছে, বেসরকারি খাতের পাটকলগুলোর শ্রমিকদের মাসিক মূল মজুরি ২ হাজার ৭০০ টাকা। তবে ২০১৫ সালে সরকারি পাটকলগুলোতে মজুরি ৮ হাজার ৩০০ টাকায় উন্নীত হয়েছে, যা বেসরকারি পাটকলের প্রায় তিন গুণ। উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় বাজারে টিকে থাকতে কম দামে পাটপণ্য বিক্রি করতে হয়। এতে পাট খাতের সার্বিক প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ বিনষ্ট হয়।
খুলনার প্লাটিনাম জুট মিলে ২৫ বছর ধরে কাজ করেছেন খলিলুর রহমান। তিনি পাটকলটির শ্রমিকনেতাও। শ্রমিকের কারণে পাটকলের লোকসানের বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে খলিলুর রহমান গত রোববার বলেন, সরকারি পাটকলের যন্ত্রপাতি ৬০-৭০ বছরের পুরোনো। ফলে পাটকলের উৎপাদনক্ষমতা ৪০-৪৫ শতাংশে নেমে যায়। সে কারণে এক টন পণ্য উৎপাদনে বেসরকারি মিলে যেখানে ২৫-২৮ জন শ্রমিক লাগে, সেখানে সরকারি মিলে প্রয়োজন হতো ৬৫-৭০ জন। তা ছাড়া পাটের মৌসুমে সুলভ মূল্যে কাঁচা পাট না কিনে পরবর্তী সময়ে বেশি দামে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কেনাটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। তাতে ১ হাজার ২০০ টাকা মণের পাট অনেক সময় ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায় কেনা হতো।
পাটের সুসময়ে পাটকল বন্ধ
পাট ও পাটপণ্য রপ্তানিতে কিন্তু এখনো সুসময় চলছে। করোনাভাইরাসের কারণে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্যসহ অন্য বড় সব খাতের রপ্তানি আয় যেখানে কমে গেছে, সেখানে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে। গত অর্থবছরে ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই আয় তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
বিদায়ী অর্থবছরের ৮৮ কোটি ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানির মধ্যে পাটসুতা ৫৬ কোটি ডলারের। নব্বইয়ের দশকে যাত্রা শুরু করা বেসরকারি পাটকলগুলোই বর্তমানে পাটসুতা রপ্তানি করছে। সেই পাটসুতা রপ্তানি করেই মুনাফা করছে একেকটি পাটকল। তবে সরকারি পাটকলগুলো তার ধারেকাছেও ছিল না। বস্তা দিয়ে উৎপাদন শুরু করা সরকারি পাটকলগুলোর কার্পেটের নিচের অংশের কাপড় বা সিবিসি উৎপাদনই ছিল মূল কাজ। কয়েক বছর ধরে কয়েক ধরনের পাটের ব্যাগ করলেও বহুমুখী পণ্য উৎপাদনেও পিছিয়ে ছিল বিজেএমসি। সোনালি ব্যাগ নামে পাটের পলিব্যাগ ও পাট থেকে পানীয় উৎপাদনের বিষয়টি ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করলেও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ বহুমুখী পাটপণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি রাশেদুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নব্বইয়ের দশকে বিশ্বব্যাংকের তহবিল দিয়ে ভারতের পাটকলগুলোর আধুনিকায়ন করে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করেছে। আমাদের সরকারি পাটকল আধুনিকায়নে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বর্তমানে ভারতের পাটকলে একজন শ্রমিক যে পরিমাণ উৎপাদন করেন, তা আমাদের পাটকলে লাগত চারজন।’ তিনি বলেন, আকিজ, জনতার মতো বেসরকারি মিলগুলো আধুনিক যন্ত্রপাতি বসিয়ে মুনাফা করছে। আর দুর্নীতি, অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, আধুনিকায়নের অভাব ও নীতিসহায়তার অভাবে ডুবেছে সরকারের পাটকলগুলো।
বিশ্বব্যাপী পলিথিন ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে বিভিন্ন দেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নে পলিব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাতে পাটের ব্যাগের চাহিদা বেড়েছে। সুযোগটি ভালোভাবে কাজে লাগানো গেলে পাটপণ্যের রপ্তানি বহুগুণ বাড়ানো সম্ভব বলে মন্তব্য করেন রাশেদুল করিম।
>মেশিনের কম উৎপাদনশীলতা, বেশি দামে কাঁচা পাট ক্রয়, পণ্যবৈচিত্র্য না থাকার সঙ্গে বিজেএমসির কর্মচারীদের অদক্ষতা লোকসানের বড় কারণ
বেসরকারি বনাম সরকারি পাটকল
১৯৮৪ সালে কুষ্টিয়ার বিসিক শিল্প এলাকায় সাড়ে পাঁচ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় নর্দান জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি। বেসরকারি খাতের মিলটি গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পাটের সুতা বিক্রি করে মুনাফা করেছে ছয় কোটি টাকা।
দেশে বেসরকারি খাতে অন্যতম বড় পাটকল আকিজ জুট মিলস। গত ২০১৫ সালে ৮১ হাজার ৩৩৮ মেট্রিক টন পাটপণ্য রপ্তানি করে
প্রতিষ্ঠানটি। গত বছর সেটি বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৬২ মেট্রিক টন। তার মানে তিন বছরের ব্যবধানে আকিজের পাটের সুতার রপ্তানি বেড়েছে ২৪ হাজার ৭২৪ মেট্রিক টন। অন্যদিকে সরকারি পাটকলের রপ্তানি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮৩৫ কোটি টাকা হলেও পরের বছর সেটি কমে ২৫৬ কোটি টাকায় দাঁড়ায়।
শুধু তা-ই নয়, গত বছর যেখানে আকিজ একাই ১ লাখ মেট্রিক টন পাটপণ্য রপ্তানি করেছে, তার বিপরীতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে-বিদেশে সরকারি ২২টি পাটকলের পাটপণ্য বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার ৫৩ শতাংশ বা ৫৮ হাজার ৩৬৫ মেট্রিক টন পাটজাত পণ্য বিক্রি করতে পেরেছে বিজেএমসি।
কুমিল্লার দাউদকান্দিতে ১৯৮২ সালে যাত্রা শুরু করা সোনালী আঁশ ইন্ডাস্ট্রিজ পাটপণ্য ব্যবসায় ভালো করছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, কাঁচা পাট কেনা থেকে শুরু করে উৎপাদন পর্যায়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি প্রয়োজন। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আবার পাটের বস্তার দাম প্রতিদিন ওঠানামা করে। কিন্তু বিজেএমসি দিনের পর দিন একটি মূল্য নির্ধারণ দিয়ে রাখে।
সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির কারণেই পাটকলগুলো টিকে ছিল বলে মন্তব্য করেন মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, বেসরকারি খাতের শতাধিক জুট স্পিনিং মিলে বছরে সাড়ে ৪ লাখ মেট্রিক টন পাটসুতা উৎপাদনে কাজ করেন ৬৫ থেকে ৭০ হাজার শ্রমিক। আর সরকারের পাটকলে ৫০-৬০ হাজার মেট্রিক টন পাটপণ্য উৎপাদনে স্থায়ী ও বদলি শ্রমিক মিলে কাজ করেন ৫০ হাজারের বেশি শ্রমিক। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে বিজেএমসির পাটকল লাভ করবে কীভাবে?
পাটের বস্তার ব্যবসায় ব্যর্থতা
পাট খাতের পুনর্জাগরণ ও পরিবেশদূষণ রোধে পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন করে সরকার। ২০১৩ সালে আইনটির বিধিমালা সংশোধন করে ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার, চিনি সংরক্ষণ, সরবরাহ ও মোড়কীকরণে পাটের বস্তার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। পরবর্তী সময়ে দুই দফায় আরও ১৩টি পণ্যে পাটের বস্তা বাধ্যতামূলক করা হয়। তাতে দেশের ভেতরে পাটের বস্তার বিরাট চাহিদা তৈরি হয়। শুরুতে সুবিধাটি নিতে পারলেও ধীরে ধীরে সরকারি পাটকলের হিস্যা কমে যায়। বর্তমানে পাটের বস্তার বড় ব্যবসাই করে বেসরকারি পাটকলগুলো।
বিজেএমসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় স্থানীয় বাজারে পাটের বস্তা বিক্রি বাড়াতে ২৫-৫০ শতাংশ মূল্যছাড় দেওয়া হয়। তারপরও বস্তা বিক্রি বাড়েনি। আসলে বেসরকারি পাটকলগুলো বিজেএমসির অর্ধেক দামে বস্তা বানায়। ফলে সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোই কেবল করপোরেশনের বড় ক্রেতা।
পিপিপিতে কি চলবে পাটকল
সরকারের পাটকলে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ২৪ হাজার ৮৮৬। বদলি ও দৈনিকভিত্তিক শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার। পাটকল বন্ধ করতে স্থায়ী শ্রমিকদের চাকরি গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অবসায়ন হবে। তাতে একেকজন শ্রমিক ১৪ লাখ থেকে ৫৪ লাখ টাকা করে পাবেন। শ্রমিকদের পাওনার ৫০ শতাংশ অর্থ নগদে ও বাকিটা তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র আকারে সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরিশোধ করা হবে। এ ছাড়া ২০১৩ সাল থেকে অবসরে যাওয়া ৮ হাজার ৯৫৬ শ্রমিকের পাশাপাশি বদলি শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হবে। সে জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি পাটকল চালানোর কাঠামোই বিজেএমসিতে নেই। শ্রমিক নিয়োগ থেকে শুরু করে কাঁচা পাট ক্রয়, উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ে নানা রকম অব্যবস্থাপনা ছিল। তার সঙ্গে দুর্নীতি যুক্ত হওয়ায় পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। তা ছাড়া বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে পাটকলকে ব্যবহার করা হয়েছে। মোদ্দা কথা, মুনাফা করার চিন্তাভাবনা নিয়ে কখনোই পাটকলগুলো চালানো হয়নি। সরকারের রাজনৈতিক আগ্রহ ছিল বলেই বছরের পর বছর লোকসান করে পাটকলগুলো টিকে ছিল।
বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকলগুলো সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) চালানোর চিন্তাভাবনা করছে বিজেএমসি। তবে করপোরেশনের সাবেক দুই চেয়ারম্যান ও কয়েকজন বেসরকারি ব্যবসায়ী বলেন, পিপিপিতে চালানো লাভজনক হবে কি না, তা দেখার জন্য আগে দু-তিনটি পাটকল পাইলট ভিত্তিতে চালানো দরকার।
পিপির সফলতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে সিপিডির গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পিপিইর মাধ্যমে সরকারি কলকারখানা চালানোর অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়।