সেলুন খুলে মলিন মুখে শুধুই অপেক্ষা
করোনায় বেশির ভাগ মানুষই ঘরবন্দী। তিন মাস ধরে চুল কাটাতে সেলুনে যাননি ছেলে-বুড়ো কেউ। বরং ঘরবন্দী জীবনে বাসায় বসে চুল ফেলে মাথা ন্যাড়া করার এক ট্রেন্ড দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেসব ছবি কিছুদিন ভাইরালও হয়েছে। এ ভাইরাল হওয়া ন্যাড়া মাথার আড়ালে লুকিয়ে ছিল নরসুন্দরদের জীবনের দুঃখগাথা। তাঁদের কাজটাই অনেকে ঘরে বসে বিকল্প পথে সেরেছেন। কিন্তু থেমে যায় নরসুন্দরের ক্ষুর–কাঁচির শব্দ। টান লাগে জীবিকার চাকায়।
গত মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে রাজধানীসহ দেশের পাড়া–মহল্লার প্রায় সব সেলুন বন্ধ আছে। জুন মাসে কিছু কিছু সেলুন খোলা শুরু হয়েছে। কিন্তু করোনার ভয়ে কেউ এখনো সেলুনমুখী হচ্ছেন না।
নরসুন্দরদের দুর্দিনের কথা ভাবতে ভাবতেই কথা হয় রাজধানীর আশকোনা হজ ক্যাম্প এলাকার ‘মা সেলুন’–এর আবদুস সালামের সঙ্গে। করোনা হানা দেওয়ার আগে এক যুগের বেশি সময় ধরে আবদুস সালামের কাছেই নিয়মিত চুল কাটাই। মাঝে তিন মাস করোনা ওলটপালট হয়ে যাওয়া জীবনযাত্রায় আবদুস সালামরা দূরেই সরে ছিলেন। গত শুক্রবার সকালে ফোন দিতেই অপর প্রান্ত থেকে আক্ষেপের সুর ‘ভাই, মনে পড়ল শেষ পর্যন্ত।’ আসলেই তো, এ বদলে যাওয়া সময়ে আবদুস সালামদের কথা আমরা অনেকেই ভুলে গেছি।
>সেলুন বন্ধ থাকায় দেশের নরসুন্দরেরা বেকার হয়ে পড়েছেন। মানবেতর জীবনযাপন করছেন তাঁরা।
কী খবর এমন প্রশ্নে আবদুস সালাম বলতে শুরু করেন তাঁর করুণ কাহিনি। জানালেন, হিমশিম খাচ্ছেন জীবন নিয়ে। তাই আগামী মাসেই বউ-বাচ্চা, মাকে গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কারণ জানতে ফের প্রশ্ন করতে হয়নি। নিজেই বলে চললেন, উপার্জন নেই। সংসার চালাতে পারছেন না। ঋণের বোঝা অনেক বেড়ে গেছে।
স্ত্রী, দুই মেয়ে, মা–সহ সালামের পাঁচজনের সংসার। চারজনকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে মেসে উঠবেন। যদি সুদিন ফিরে আসে, আবার ফিরিয়ে আনবেন পরিবারের সদস্যদের। স্বপ্ন ছিল দুই মেয়েকে ঢাকার কোনো স্কুলে পড়াবেন। কিন্তু করোনা আপাতত সেই স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে সালামের।
গত তিন মাসের মধ্যে প্রথম আড়াই মাসই সেলুন বন্ধ ছিল। এপ্রিল মাস পার করেছেন জমানো টাকায়। ভেবেছিলেন ঠিক হয়ে যাবে মে মাসে সব। কিন্তু হয়নি। বিপদ বাড়ল। বাসাভাড়া, সেলুন ভাড়ার টাকা জোগাড় করতে হাত পাতলেন। বাসা ও সেলুনের ভাড়া দেওয়ার পর যা থাকল, তা দিয়ে কষ্টেসৃষ্টে কাটল কোনোরকমে মাসটি। কিন্তু জুনে এসে চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেন। তখনই সিদ্ধান্ত নেন পরিবারকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার। আর একপ্রকার ঝুঁকি নিয়ে ৭ জুন চালু করেন সেলুন।
কিন্তু পরিচিত কেউই এখন সেলুনমুখী হন না। মলিনমুখে সকাল থেকে রাত অবধি অপেক্ষায় থাকেন। দিন শেষে ৪০০-৫০০ টাকা আয় হয়। অথচ আগে দিনে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। নিজে ভীষণ কষ্টে আছেন। সেই আক্ষেপ থেকে বলেন, ‘চুল না কাটলে মানুষ মরবে না। কিন্তু করোনা হলে মরবে। এই ভয়ে কেউ চুল কাটতে আসে না।’
সালামের এমন গল্প এখন রাজধানীসহ সারা দেশের প্রায় সব নরসুন্দরের। করোনায় নরসুন্দরদের জীবন ও জীবিকা দুটোই হুমকির মুখে ফেলেছে। জানা গেছে, রাজধানীর দক্ষিণখান ও উত্তরখান থানা এলাকায় প্রায় চার থেকে সাড়ে চার হাজার নরসুন্দর আছেন। স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক আয় ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর এই নরসুন্দরদের সিংহভাগই বাড়ি চলে গেছেন। অনেকে পেশা পরিবর্তন করে রিকশা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। অনেকেই দিনমজুরের কাজে যুক্ত হয়েছেন।
যাঁরা এখনো পেশা বদল করেননি, তাঁরাও ভালো নেই। সেলুন খুলেছেন ঠিকই কিন্তু ক্ষুর–কাঁচিতে শাণ দিতে হয় না। ভালো নেই অন্যকে দেখতে সুন্দর লাগার কাজে যুক্ত নরসুন্দরেরা। অনেকটা মানবেতর জীবনযাপন করছেন তাঁরা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সীমিত পরিসরে সেলুন খোলা হলেও গ্রাহক নেই বললেই চলে।
সারা দেশে সেলুনের সংখ্যা কত তার সঠিক কোনো হিসাব নেই। আবার নরসুন্দরের পেশায় কতজন আছেন, তা–ও বলা কঠিন। এই খাতের সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা গেছে, দেশে নরসুন্দরের সংখ্যা সাত-আট লাখ। এর মধ্যে ঢাকায় লাখখানেকের বেশি সেলুনকর্মী আছেন। এই সেলুনকর্মীরাই এই শহরের মানুষের চুল-দাড়ি কেটে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখেন। তাঁরাই এখন বড় অসহায়। ভবিষ্যৎ তাঁদের অপরিষ্কার।
এখানেই শেষ নয়। সেলুনের পেছনের গল্পও আছে। সেলুন বা বিউটি পারলারের ফেলে দেওয়া চুলের বেচাকেনার ব্যবসাও আছে। পরচুলাসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরিতে চুল ব্যবহার করা হয়। আবার চুল রপ্তানিও হয়। করোনায় সেই ব্যবসা যেন হারিয়ে গেছে। চুল কিনতে এখন আর ফড়িয়ারা সেলুনে আসেন না। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ হিসাবমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সোয়া তিন কোটি ডলারের কৃত্রিম ও মানব চুল রপ্তানি হয়েছে। বর্তমান বাজারদরে টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ প্রায় পৌনে তিন শ কোটি টাকা।