২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বাজেটে ব্যাংক সংস্কার উধাও

বাজেট যায়, বাজেট আসে। নতুন বাজেটে নতুন নতুন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, আর সেই সঙ্গে হারিয়ে যায় আগের বাজেটে দেওয়া প্রতিশ্রুতি। যেমন এবার বাজেট বক্তৃতা থেকে হাওয়া হয়ে গেছে ব্যাংক খাতের সংস্কার ও কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতিটি।

২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় প্রথমবারের মতো ব্যাংক কমিশনের ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এরপর প্রতিটি বাজেটে একই ধরনের ঘোষণা দেওয়া ছিল। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে আরও স্পষ্ট করে ব্যাংক কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরের নতুন বাজেটে এ নিয়ে কোনো কথাই নেই।

তাহলে কি একটি ব্যাংক কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে, ভালো হয়ে গেছে দেশের ব্যাংক খাত? এমনকি বন্ধ হয়ে গেছে রাজনৈতিক চাপ, খেলাপিরাও সব ভালো গ্রাহক বনে গেছেন, আইনে যেমনটা বলা আছে, ঠিক সেভাবেই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এ নিয়ে জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপনি জানেন না, দেশের ব্যাংক খাত ভালো হয়ে গেছে! সব প্রভাবশালী, ঋণখেলাপিরা নিয়মিত টাকা ফেরত দিচ্ছেন! এ জন্যই মনে হয় পরিকল্পনা করেই এসব বাদ দেওয়া হয়েছে।’

ব্যাংক সংস্কার কেন প্রয়োজন

অথচ পরিচালনা ও তদারকি দুর্বলতার কারণে নাজুক পরিস্থিতিতে পড়ে আছে দেশের ব্যাংক খাত। বেনামি ও খেলাপি ঋণে জর্জরিত কয়েকটি ব্যাংক। অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা। তারপরেও নানা ধরনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে ঋণখেলাপিদের, প্রভাব বেড়েছে তাদের। এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ন্যাশনাল ব্যাংকের মালিকপক্ষের গুলি করার ঘটনায় ব্যাংক খাতের অন্য এক চেহারাও এরই মধ্যে দেখা গেছে।

>

২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট থেকে প্রতি অর্থবছর কেবল ব্যাংক কমিশন গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে এবার বাজেটে এ নিয়ে কোনো কথাই নেই।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) কাজ করা অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর এ নিয়ে বললেন, ‘সরকার কঠোর না হলে তারা কখনোই ঠিক হবে না। ঋণখেলাপিদের নানা সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তাদের চাপেই নীতিমালা, বিভিন্ন আইন শিথিল হয়েছে। করোনার মধ্যেও নিশ্চয়ই তারা সুযোগ নেওয়ার অপেক্ষা করছে। তাই ব্যাংক খাত সংস্কার ও ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর না হওয়ার বিকল্প নেই। এ জন্য কমিশন গঠন প্রয়োজন। নইলে তাদের কারণেই সংকট আরও বাড়বে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা, আর ২০১২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২ লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়েছে। অবলোপনের মাধ্যমে খেলাপি থেকে বাদ পড়েছে ৫৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রকৃত খেলাপি ঋণ কয়েক গুণ বেশি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও এসব ধরে খেলাপি ঋণ হিসাব করার পক্ষে।

আবার ডিসেম্বর শেষে দেশের ১৫ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের ওপরে। অনিয়ম-জালিয়াতি সামলাতে ১৫ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও এসব ব্যাংকের কোনো উন্নতি হচ্ছে না।

ধারাবাহিক প্রতিশ্রুতি

সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে প্রথম ব্যাংক খাতের কার্যক্রম মূল্যায়নে একটি কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। পরে ২০১৬ সালের ১৩ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ব্যাংক খাতকে অধিকতর নজরদারির মধ্যে আনতে অর্থ মন্ত্রণালয় কমিশন গঠনের কাজ শুরু করেছে। এরপর ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আবার জানান যে সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে ব্যাংক কমিশন গঠন করবে এবং পরবর্তী সরকারের জন্য তা রেখে যাবে। এরপর ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিটি বাজেট বক্তব্যেই মুহিত ব্যাংক কমিশন গঠনের পক্ষে কথা বলে গেছেন।

 এরপর ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, ‘ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা সুদৃঢ় করার জন্য একটি ব্যাংক কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা আমরা দীর্ঘদিন ‍শুনে আসছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’ এই ঘোষণার পরে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও হঠাৎ করেই তা থেমে যায়। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কমিশন গঠন করলে ব্যাংক খাতের আরও দুর্বল চিত্র বের হয়ে আসতে পারে। এ জন্য সরকার কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছে না।

 বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই অর্থমন্ত্রী খেলাপিবান্ধব। খেলাপিদের নানা সুযোগ দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। আমানতকারীদের প্রতি কোনো নেজর নেই। এ কারণে এখন আর ব্যাংক কমিশন গঠনের কোনো আশা করি না।’