অর্থনীতির সংকট থেকে উত্তরণের উপায় কী
চলমান সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সূচকের কোনো দিকেই স্বস্তিদায়ক খবর নেই। রপ্তানি বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি বড় ধরনের কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমদানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বেশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। এটি সামগ্রিকভাবে আমাদের ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের জন্য খুবই নেতিবাচক বিষয়। লকডাউন পরিস্থিতিতে সারা দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম থমকে গেছে। অন্যদিকে, উন্নত বিশ্বের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি মন্দার আশঙ্কা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য হ্রাসের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ে প্রবাহে বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। চলমান অর্থনৈতিক সংকট দেশে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য হারেরও বড় ধরনের উল্লম্ফনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সামগ্রিকভাবে, এ বছর আর্থিক প্রবৃদ্ধি বেশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ থেকে উত্তরণের উপায় কী? একটি কথা মনে রাখা দরকার যে এই সংকটজনক পরিস্থিতির চটজলদি কোনো সমাধান নেই। আমাদের দরকার দুই অথবা তিন বছরের একটি ‘অর্থনীতি পুনরুদ্ধার’ পরিকল্পনা, যার অধীনে আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রণয়ন প্রয়োজন।
সামনের অর্থবছরের বাজেট হওয়া দরকার একটি ‘কোভিড-১৯ সংবেদনশীল বাজেট’। এই বাজেটে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি অগ্রাধিকার ক্ষেত্র থাকা উচিত। যেমন পরিকল্পনামাফিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করার ব্যবস্থা নেওয়া, স্বাস্থ্য, কৃষি ও সামাজিক সুরক্ষা খাতের জন্য উচ্চতর বরাদ্দ, প্রণোদনা প্যাকেজের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং ব্যাংকিং ও কর খাতসহ কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ে কার্যকরী সংস্কার কর্মসূচি নেওয়া ও বাস্তবায়ন করা।
অবশ্যই স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনা করে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধাপে ধাপে পরিকল্পনামাফিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করা দরকার। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, দৃশ্যমান এ রকম কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই ৩১ মে থেকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করা হয়েছে, যা কিনা স্বাস্থ্যঝুঁকির মাত্রা অনেক বাড়িয়ে দিতে পারে, এবং পরিণামে আবারও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বড় পরিসরে বন্ধ করার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। তাই এই সিদ্ধান্তের জরুরি পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন।
বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বড় ধরনের বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। একই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে স্বাস্থ্য খাতে অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়নের দ্রুত পরিকল্পনা নেওয়া এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন। এই খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া প্রয়োজন।
সাধারণ বছরগুলোর বাজেটে কৃষি যেভাবে গুরুত্ব পেয়ে থাকে, এবারের বাজেটে তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তার একটি বড় কারণ হচ্ছে, এখন যে সংকটটি চলছে সেই সংকটে সামনের দিনগুলোতে খাদ্যনিরাপত্তায় একটি বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। খাদ্যনিরাপত্তার সংকট শুধু বাংলাদেশের নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সংকটের দিকে যেতে পারে। বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতেও বরাদ্দ অনেক বাড়ানো প্রয়োজন।
সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের যথাযথ বাস্তবায়ন যাতে হয়, তা নিশ্চিত করা দরকার। যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা সম্ভব। তবে এই প্রণোদনা প্যাকেজের বড় অংশই ব্যাংক খাতের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে, যা ইতিমধ্যে দুর্বল ব্যাংক খাতের ওপর নতুন করে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছে। তাই ব্যাংক খাতের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত বড় ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কাটানোর জন্য জরুরি সংস্কার পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
সেলিম রায়হান: নির্বাহী পরিচালক, সানেম এবং অধ্যাপক অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়