অবরুদ্ধ অবস্থায় ক্ষতি ১ লাখ কোটি টাকা
>দেশে ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটির সময়ে অর্থনীতির ক্ষতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপকের গবেষণা।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় গত ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে যে অবরুদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ১ লাখ ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি (অনুমিত) হবে। আর অবরুদ্ধ পরিস্থিতি মে মাস পর্যন্ত চললে ক্ষতির পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি হতে পারে। এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে দেশে ক্ষতির পরিমাণ প্রতিদিন ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
‘অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব: আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এ গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ। তাঁর গবেষণায় বাংলাদেশের অর্থনীতির তিনটি বড় খাত—কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের পাশাপাশি এ তিন খাতের উপখাতগুলোও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রতিদিনের গড় আর্থিক মূল্য বিবেচনায় নিয়ে গবেষণাটি করা হয়েছে।
সৈয়দ আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৮-১৯ সালের জিডিপির নিরিখে স্বল্প মেয়াদে চলতি ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন উপখাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে সীমিত আকারে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে গবেষণাটিকরা হয়েছে। গত ২৮ মার্চ থেকে চলতি এপ্রিল মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত গবেষণার জন্য টেলিফোনে প্রয়োজনীয় সাক্ষাৎকার ও তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, কৃষির প্রধান উপখাত হলো শস্য উৎপাদন, প্রাণিসম্পদ এবং মৎস্যসম্পদ। স্বল্প মেয়াদে এসব উপখাতে উৎপাদন না কমলেও দেশি ও বিদেশি অর্থনীতি অবরুদ্ধ থাকার ফলে উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্যের ওপর নিম্নমুখী প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এর ফলে অর্থনীতিতে প্রতিদিন প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। গবেষণার হিসাব বলছে, শিল্প, বিশেষ করে উৎপাদন ও নির্মাণ খাতে ক্ষতি প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ খাতে প্রতিদিনের অনুমিত ক্ষতি ১ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। সেবা খাতে প্রতিদিনের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। এ খাতের অনুমিত ক্ষতি ২ হাজার কোটি টাকা।
এ গবেষণার বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্ষতি যে বিপুল পরিমাণ হচ্ছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু আমার দেখা ১ হাজার ৬০০ প্রকল্প আছে, যেগুলোর প্রায় সব কটি এখন বন্ধ। এ ছাড়া ১০ কোটি, ৫ কোটি বা ১ কোটি টাকার অসংখ্য প্রকল্পও এখন বন্ধ।’ তিনি বলেন, ‘এখন যে ক্ষতি হচ্ছে, তা পুষিয়ে নেওয়ার মতো স্কিল (দক্ষতা) কারও আছে বলে মনে হয় না। কমানোর চেষ্টা করা যাবে। কিন্তু ক্ষতি অপূরণীয়।’
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় দেশে ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি চলছে। সরকারের তরফে ছুটি বলা হলেও গণপরিবহন, দোকানপাট, শিল্প কারখানা বন্ধ থাকায় আসলে একধরনের অবরুদ্ধ পরিস্থিতি বা লকডাউন চলছে। এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ ও বিশ্ব অর্থনীতির চরম সংকটের বার্তা দিচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ‘সাউথ এশিয়া ফোকাস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ২ থেকে ৩ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলেছে, এ বছর প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ হবে। যদিও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আশাবাদী, এ বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হবে।
লকডাউন বা অবরুদ্ধ অবস্থাকে তিন পর্বে ভাগ করে তিন ধরনের সম্ভাব্য ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে গবেষণায়। এতে বলা হয়েছে, ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত অবরুদ্ধ অবস্থার কারণে অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে কমপক্ষে ১ লাখ ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এ অবরুদ্ধ অবস্থা ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত চললে ক্ষতি হবে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে অবরুদ্ধ অবস্থা পুরো মে মাসে যাবে কি না, তা নিয়ে ভাবনা আছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, মে মাস শেষে অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ১৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, যা গত বছরের জিডিপির প্রায় ৯ শতাংশ।
করোনার কারণে ক্ষতি বহুমাত্রিক বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো নাজনীন আহমেদ। তিনি অধ্যাপক হামিদের গবেষণার সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, প্রকৃত ক্ষতি এর চেয়েও বেশি হতে পারে। যাঁরা ইতিমধ্যে কাজ হারিয়েছেন, তাঁরা যে খরচ করতেন, তার একটা অর্থনৈতিক মূল্য আছে। এখন এসব মানুষ সঞ্চয় ভাঙিয়ে ফেলেছেন, খাবারের জন্য সেটি তাঁরা নষ্ট করছেন। আবার নিম্ন আয়ের মানুষ কিছু না কিছু নতুন বিনিয়োগ করতেন। এখন নতুন উৎপাদনের জন্য সেই বিনিয়োগও হবে না। অর্থাৎ ক্ষতি বহুমাত্রিক।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে ৯৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। অধ্যাপক আবদুল হামিদ বলেন, তাঁর গবেষণায় উঠে আসা অনুমিত ক্ষতির হিসাব সরকারঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের যথার্থতা নিরূপণ করতে সহায়তা করবে।