নতুন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গোটা বিশ্ব বলা যায় স্থবির হয়ে গেছে। বিদ্যমান এই স্থবির ও অবরুদ্ধ অবস্থা ইতিহাসের ঠিক কোন সময়কালের মতো, তা নিয়েও চলছে নানা জল্পনা। এই ২০২০ সাল অতীতের ঠিক কোন সময়ের সঙ্গে তুলনীয়? ১৯১৪, ১৯২৯ নাকি ১৯৪১?
উত্তর খুঁজতে হলে নাকাল হতে হবে। কারণ, বর্তমান পরিস্থিতি দুটি বিশ্বযুদ্ধ ও তিরিশের মহামন্দা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এমনকি ১৯১৮ সালে শুরু হওয়া স্প্যানিশ ফ্লুর সঙ্গেও এই পরিস্থিতি তুলনীয় নয়। কারণ, আগের ওই সময়গুলো থেকে এখনকার বিশ্ব কাঠামোগত দিক থেকেই একেবারে আলাদা। নতুন করোনাভাইরাস তাই ঐতিহাসিকভাবেই এক নতুন পরিস্থিতির মুখে ফেলেছে গোটা বিশ্বকে।
নতুন করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারি এই সংকটের একটি দিক। আরেকটি গুরুতর দিক হচ্ছে অর্থনীতি। এই সংকট বৈশ্বিক অর্থনীতিকেই এক ভীষণ দুর্বিপাকে ফেলে দিয়েছে। ঠিক কতটা? যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকানো যাক। দেশটির অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থার থেকে এক-চতুর্থাংশ সংকুচিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা তিরিশের মহামন্দার সমান। মুশকিল হচ্ছে, মহামন্দার সময় এই সংকোচন হয়েছিল চার বছর ধরে। আর এখন এটি হতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ কয়েক মাস। এর আগে এমন ভয়াবহ পতন আর দেখা যায়নি।
মার্কিন অর্থনীতি নিয়ে ফরেন পলিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাত্র পাঁচ সপ্তাহ আগে মার্চের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার ছিল রেকর্ড সর্বনিম্ন পর্যায়ে, যা মার্চের শেষ নাগাদ ১৩ শতাংশে উন্নীত হয়। এই হার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্বোচ্চ। এক হিসাবে দেখা গেছে, দেশটিতে বেকারত্বের হার গড়ে প্রতিদিন দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে গ্রীষ্ম শেষ হওয়ার আগেই এ হার ৩০ শতাংশে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়। পুরো পশ্চিমা বিশ্বই এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আবাসন, নির্মাণ খাত বা শ্রমঘন শিল্প খাতগুলো, যেগুলোর উৎপাদন মূলত বিনিয়োগকারীদের সক্রিয়তার ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল, সেগুলো ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই খাতগুলোয় পড়া নেতিবাচক প্রভাব আবার প্রভাবিত করছে অর্থনীতির অন্য সব সূচককে।
নতুন করোনাভাইরাস সরাসরি আঘাত করেছে খুচরা দোকান, আবাসন, শিক্ষা, বিনোদন, হোটেল ও রেস্তোরাঁর মতো খাতগুলোকে। এটি বলা যায় প্রলয়ের শুরু। খুচরা পণ্য বিক্রির খাত এমনিতেই ই-কমার্স সাইটগুলোর দিক থেকে চাপে ছিল। এর সঙ্গে এখন লকডাউনের মতো বিষয় যুক্ত হওয়ায় ধনী দেশগুলোয় এটি রীতিমতো অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো দেখা যাবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বন্ধ হওয়া দোকানগুলো আর হয়তো খুলবেই না।
ফরেন পলিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউরোপের অনেক দেশে অর্থনীতিকে সামাল দিতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এটি সংকটের ভয়াবহতাকে আড়াল করতেই বেশি কাজ করবে, সমাধানে নয়। কারণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে গেছে। বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে নাগরিকদের দুর্দশা কমানো গেলেও অর্থনীতির শুশ্রূষাটি ঠিক হয় না। ইতালির উত্তরাঞ্চল শুধু বনেদি পর্যটন কেন্দ্রই নয়, এটি ইতালির মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫০ শতাংশের জোগানদাতা। জার্মানি অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েও নিজেকে বাঁচাতে পারছে না। দেশটির জিডিপিতে ভয়াবহ প্রভাব পড়বে, যা এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি। সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে সম্ভবত জাপান, যদিও দেশটিতে ভাইরাসটির প্রকোপ অন্য অনেক দেশের তুলনায় কম ছিল।
অন্য দেশগুলোর অবস্থাও সঙিন। মুশকিল হচ্ছে ধনী দেশগুলোর ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক হিসাবটি করা গেলেও অন্য অনেক দেশের ক্ষেত্রেই যথাযথ তথ্যের অভাবে তা সম্ভব হয় না। চীনের কথাই ধরা যাক, কোভিড-১৯–এর কারণে দেশটিতে বেকারত্বের হার বেড়ে ৬ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছেছে। ১৯৯০ সাল থেকে হিসাব রাখা শুরুর পর এটিই ওই দেশে সর্বোচ্চ। চীন যদিও বলছে যে এটি তারা সামাল দেওয়ার বিষয়ে আশাবাদী, কিন্তু শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
রয়েছে ভারত। ভারতে লকডাউন শুরুর পর থেকে অসংখ্য হৃদয়বিদারক কাহিনি মানুষের সামনে এসেছে, যা ১৯৪৭ সালের পর আর দেখা যায়নি। এ কাহিনি বাড়তে থাকবে। করোনাভাইরাসের কারণে দেশটির অর্থনৈতিক ক্ষতি কেমন হবে, তা সঠিকভাবে জানার সুযোগ তেমন নেই। কারণ, তথ্য-সংকট। শুধু একটি তথ্যই যথেষ্ট—ভারতের ৪৭ কোটি ১০ লাখ মানুষ কাজের সঙ্গে যুক্ত, যার মাত্র ১৯ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় রয়েছেন। দুই-তৃতীয়াংশের বেশি কর্মীর নেই কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি। এর মধ্যে ১০ কোটি আবার পরিযায়ী শ্রমিক।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, মানুষের দুর্দশা পরিসংখ্যানকে তামাশায় পরিণত করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৈশ্বিক উন্নয়নের বিশ্বাসযোগ্য সূচক হিসেবে যে জিডিপিকে বিবেচনা করা হচ্ছিল, পরিসংখ্যান বলছে, তাতে বড় ধরনের সংকোচন হবে। উন্নয়নের বৈশ্বিক মডেলটিই বলা যায় স্থবির হয়ে পড়েছে। এই ধসের কারণ আবার আর্থিক সংকট নয়, এমনকি মহামারির সরাসরি ফলও নয় এটি। শুনতে যত অদ্ভুতই লাগুক, সত্য হচ্ছে—দেশে দেশে শাসকেরা নিজেদের ইচ্ছায় এই ধস বরণের জন্য নীতি গ্রহণ করেছেন। কিন্তু অর্থনীতিকে স্থবির করার সিদ্ধান্ত নেওয়া যত সহজ, একে সচল করা ততটা নয়।
উদাহরণ হিসেবে এই সময়ে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দেশ যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে, দেশটিতে শুধু মার্চ মাসেই স্বাভাবিক আয় হারিয়েছেন ৭৩ শতাংশ মানুষ। এই আয় হারানো মানুষেরা এখন ঋণের সন্ধানে নামবেন, যা চাপ তৈরি করবে আর্থিক খাতের ওপর। মানুষ খরচে লাগাম দিচ্ছে। ইউরোপেই যেমন পেট্রল ব্যবহার আগের চেয়ে ৮৮ শতাংশ কমেছে, যার প্রভাব সরাসরি পড়ছে জ্বালানি তেল ও গাড়ির বাজারে। বিশ্বের সব দেশের চিত্র একই। এমন দুর্যোগের সাম্য আগে কখনো দেখা যায়নি। লকডাউনের সময়কাল যত বাড়বে, অর্থনীতি তত সংকটে পড়বে এবং এর পুনরুদ্ধার তত কঠিন হবে। এমনকি আগের মতোই উৎপাদন ও জনজীবন সচল হওয়ার পরও পুরো ব্যবস্থা ঠিক হতে বিস্তর সময় লাগবে।
করোনাভাইরাসের এই সময়ে মানুষ যেন লকডাউনসহ নানা প্রশাসনিক পদক্ষেপ মেনে নেয়, সে জন্য বিভিন্ন খাতকে বাঁচাতে সরকারগুলো নানা প্রণোদনা দিচ্ছে। কৃষি, শিল্প থেকে শুরু করে নানা খাতে এই প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। অথচ অর্থনীতি আক্ষরিক অর্থেই স্থবির। এই অর্থ ঋণের অর্থ, যার হিসাবটি সংকটকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোই রাখবে। কিন্তু সংকট পার হলেই এর সমন্বয়ের প্রশ্নটি সামনে আসবে। অর্থাৎ ফের বিষয়টি যাবে সাধারণ মানুষের ঘাড়েই। ব্যয় সংকোচন ও কর-হার বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারগুলো এই অর্থ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করবে। এ দুই পদক্ষেপের কারণেই নাভিশ্বাস উঠবে আসলে সাধারণ মানুষের, যাদের একটি বড় অংশ তত দিনে নিঃস্বপ্রায়। এটি সম্পূর্ণ এক নতুন পরিস্থিতির মুখে এনে ফেলবে বিশ্বের প্রতিটি দেশকে। কারণ, সবাই আক্রান্ত বলে বাইরে থেকে অনুদান বা ঋণের অর্থ এনেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সুযোগ থাকছে না।
অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) মহাসচিব অ্যাঞ্জেল গার কিছুদিন আগে বিবিসিকে বলেছেন, ‘আর্থিক সংকটের চেয়েও বড় সংকট এটি। এই পরিস্থিতি সামলে পূর্বাবস্থায় ফেরার ভাবনাটি সুন্দর কিন্তু সম্ভবত অসম্ভব। অধিকাংশ বড় অর্থনীতি মন্দার মুখে পড়বে। অনেকে বলছেন, যেভাবে পতন হচ্ছে, ঠিক সেভাবেই উত্থান হবে। আমি তেমনটা মনে করি না।’
একই মত ব্যক্ত করেছেন মার্কিন বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মর্গানের অর্থনীতিবিদ জেসে এডগারটন। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ভক্সকে তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে ভালো যা হতে পারে, তা হলো খুব দ্রুত আমরা পদক্ষেপ নিয়ে পূর্বাবস্থার কাছাকাছি পৌঁছে যাব। তবে এমনটি হবে বলে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি না।’ একইভাবে স্থায়ী ক্ষতির শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের অর্থনীতিবিদ গ্রেগ ডেকো।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এটি এমন এক পরিস্থিতি, যেখানে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক জীবন ফিরবে বলে প্রত্যাশাই শুধু করা যায়। অর্থনৈতিক যে ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে, তা পুনরুদ্ধার করে পূর্ববর্তী স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাটা সম্ভবত সম্ভব হবে না। কারণ, এরপর থেকে প্রতিটি ফ্লু মৌসুমেই মানুষ অতি সতর্ক হয়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতি এড়াতে প্রশাসনিক পদক্ষেপও নেওয়া হতে পারে, যা বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামোকে ঠিকঠাক চলতে দেবে না। একটি নতুন কাঠামো বা বিদ্যমান কাঠামোয় বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া সে ক্ষেত্রে আর উপায় থাকবে না।