ভারতের দীর্ঘতম, কিন্তু চমকহীন বাজেট
বেহাল অর্থনীতির হাল ফেরাতে বাজেটে কী কী ঘোষণা করা হয়, সেটাই ছিল আগ্রহের কেন্দ্রে। ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ সেই আগ্রহ নিরসনে এমন কিছু চমক দিতে পারলেন না। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর স্বার্থে পাঁচ বছরে বিভিন্ন প্রকল্পে যে ১০০ লাখ কোটি রুপি লগ্নির ঘোষণা করেছিলেন, নির্মলা তার ওপরই বাজি ধরতে চেয়েছেন। এর বাইরে শনিবার লোকসভায় পেশ করা তাঁর বাজেট সেই অর্থে ছিল চমকহীন।
তবে নিজের তৈরি রেকর্ড নির্মলা নিজেই ভেঙেছেন। গতবার ২ ঘণ্টা ১৭ মিনিট ধরে বাজেট ভাষণ দিয়ে রেকর্ড করেছিলেন। শনিবার ২ ঘণ্টা ৪১ মিনিট কাবার করে দিলেও তিনি ভাষণ শেষ করতে পারেননি। নিজের রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড তৈরি করেও শ্রান্তি ও ক্লান্তির দরুন শেষ দুই পৃষ্ঠা পাঠ না করে তিনি স্পিকারের অনুমতি নিয়ে বসে পড়েন। অসুস্থ অর্থমন্ত্রীর ভাষণের শেষ ওখানেই। সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসে দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে একরাশ প্রশ্ন।
আগের দিন শুক্রবারই প্রকাশিত হয়েছে আগামী অর্থবর্ষের অর্থনৈতিক সমীক্ষা। বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার কমতে কমতে তা ৩ শতাংশের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, আগামী অর্থবর্ষে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৬ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ হারে হবে। অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে চাহিদা বৃদ্ধি প্রয়োজন। প্রয়োজন সাধারণ মানুষের হাতে টাকার জোগান বাড়ানো। সে জন্য কৃষিক্ষেত্রের দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা অর্থনীতিবিদেরা বারবার বলে এসেছেন। বাজেট ভাষণে কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে ১৬টি নতুন পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। বরাদ্দ করেছেন ২ লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকা। বলেছেন, ২০২২ সালের মধ্যে কৃষি আয় দ্বিগুণ করতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কৃষক যাতে উৎপাদিত ফসল সহজে বাজারজাত করতে পারেন, কৃষিঋণ যাতে সহজলভ্য হয় এবং হিমঘরে ফসল সংরক্ষণ যাতে করা যায়, সে জন্য বিশেষ নজর দেওয়া হবে। কিন্তু উৎপাদন শিল্পের হাল কীভাবে ফিরবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা বাজেট থেকে পাওয়া গেল না।
অর্থনৈতিক সংকটের মারাত্মক প্রতিফলন ঘটেছে কাজের বাজারে। কর্মসংস্থান দিন দিন কমে যাচ্ছে। কীভাবে তা ঠেকানো যাবে, তার কোনো দিশাও নির্মলা সীতারমণ দেখাতে পারেননি। বিরোধীরা তাই বলেছেন, দীর্ঘতম বাজেট ভাষণ ও পর্বতের মূষিক প্রসব সমার্থক।
>ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ দীর্ঘতম বাজেট বক্তৃতা শেষ করতে পারলেন না। এটি অর্থনীতিকে সুস্থ করতে পারবে কি না, সেটাই প্রশ্ন।
নির্মলা সীতারমণ কর কাঠামোয় বিন্যাস ঘটিয়ে আয়করে সামান্য ছাড় দেওয়ার পাশাপাশি তুলে নিয়েছেন বিভিন্ন ছাড়। পুরোনো কাঠামোর বিন্যাস ছিল ৫ লাখ পর্যন্ত আয়ে ৫ শতাংশ হারে কর। নতুন ব্যবস্থায় তা অপরিবর্তিত। ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা আয়ের ক্ষেত্রে কর ছিল ১০ শতাংশ। ১০ থেকে ২০ লাখ পর্যন্ত ২০ শতাংশ। ২০ লাখের বেশি আয় হলে আয়কর ৩০ শতাংশ। নতুন বিন্যাসে কর প্রস্তাব হলো, ৫ থেকে সাড়ে ৭ লাখ পর্যন্ত ১০ শতাংশ, সাড়ে ৭ থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত ১৫ শতাংশ। ১০ থেকে সাড়ে ১২ লাখ পর্যন্ত ২০ শতাংশ। সাড়ে ১২ থেকে ১৫ লাখ পর্যন্ত ২৫ শতাংশ। ১৫ লাখের বেশি ৩৫ শতাংশ। নতুন এই ব্যবস্থায় কর দিলে পুরোনো ব্যবস্থার করছাড়গুলো নেওয়া যাবে না। সেই সুবিধা নিতে গেলে পুরোনো ব্যবস্থায় কর দিতে হবে। নির্মলার এই ‘সুরাহা’ হলো ডান হাতে দিয়ে বাঁ হাতে কেড়ে নেওয়া।
নির্মলার এই ঘোষণা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা জীবনবিমা করপোরেশনের (এলআইসি) চিন্তা বাড়িয়েছে। এলআইসি পলিসি কিনলে আয়করে ছাড় পাওয়া যেত। নতুন কর বিন্যাসে সেই সুযোগ থাকবে না। দেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারি সমবায় ব্যাংক সমস্যার মধ্যে রয়েছে। এত দিন ব্যাংক আমানত বিমার পরিমাণ ছিল ১ লাখ টাকা। ব্যাংক লাটে উঠলে ওই টাকা ফেরত পাওয়া যেত। নির্মলা সেই পরিমাণ বাড়িয়ে ৫ লাখ করেছেন।
বাজেট ভালো হলো না খারাপ, অর্থনীতির পক্ষে আশাব্যঞ্জক না হতাশার, শেয়ারবাজারে প্রতিবছরই তার প্রতিফলন ঘটে। নির্মলা সীতারমণের এই দীর্ঘতম বাজেট শেয়ারবাজারকে বিপুল হতাশায় ডুবিয়ে দিয়েছে। সেনসেক্স পড়ে যায় ১ হাজার পয়েন্ট, নিফটি ৩০০ পয়েন্টের বেশি। ভাষণ শেষ হওয়ার আগেই অসুস্থ বোধ করা অর্থমন্ত্রীর অসমাপ্ত বাজেট প্রস্তাব অর্থনীতিকে সুস্থ করতে পারবে কি না, সেই প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দিল।