ভালো-মন্দের মধ্য দিয়েই ২০১৯ সাল পার করল বাংলাদেশ। সারা বছর ধরেই নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা বিভিন্ন সূচক প্রকাশ করে থাকে। ওই সব সূচকে বাংলাদেশ আগের চেয়ে কয়েকটিতে ভালো করেছে, কয়েকটি সূচকে খারাপ করেছে। সার্বিকভাবে এসব সূচক দিয়ে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান নির্ধারণ করা হয়। বিদেশিদের কাছে দেশের ভাবমূর্তি ঠিক হয়।
ব্যবসা-বাণিজ্য, মানব উন্নয়ন, মানব পুঁজি, সুখ, ক্ষুধা, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বেশির ভাগ সূচকেই বাংলাদেশ প্রথম ১০০টি দেশের মধ্যে নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান মাঝারি বা তলানির দিকে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ভালো-মন্দ মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থান। তবে আশঙ্কার বিষয় হলো কিছু সূচকে এত দিন ইতিবাচক ধারায় থাকলেও এখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। যেমন রপ্তানি খাতে গত এক দশকে বেশ ভালো করলেও চলতি অর্থবছরে তা নেতিবাচক ধারায় গেছে। সার্বিকভাবে ব্যবসা সহজ করতে হবে বলে মনে করেন মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, সুশাসনের সূচকগুলোতে বাংলাদেশের অবস্থান মোটেও সন্তোষজনক নয়। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ আরও জোর দিতে হবে। সার্বিকভাবে জীবনমান উন্নত করতে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিল (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন সূচক প্রকাশ করে থাকে। চলতি মাসে প্রকাশিত এই সূচকে ১৮৯ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৬তম। এক বছরের ব্যবধানে এক ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। এরপরও বিশ্ব প্রেক্ষাপটে মানব উন্নয়নে বাংলাদেশের অবস্থান মাঝারি। ইউএনডিপির লিঙ্গবৈষম্য সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তেমন সুবিধার নয়। ১৬০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৩৪তম।
বিশ্বব্যাংকের মানব পুঁজি সূচক দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উৎপাদনশীলতার মান ঠিক করা হয়। দশমিক ৪৮ পয়েন্ট পেয়ে ১৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ আছে ১০৬তম। এর অর্থ, আজ যে শিশুটি বাংলাদেশে জন্ম নিচ্ছে, বড় হয়ে তার সম্ভাবনার ৪৮ শতাংশ উৎপাদনশীল হবে।
কিছু সূচক আছে, যেগুলো দিয়ে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য কতটা সহায়ক, তা বোঝানো হয়। বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করার সূচকের এবার বাংলাদেশ আট ধাপ এগিয়েছে। এবার ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮তম। গতবারের অবস্থান ছিল ১৭৬তম। বাংলাদেশ এখনো তালিকার তলানির দেশগুলোর একটি।
গত অক্টোবর মাসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচক প্রকাশ করে। সেখানে বাংলাদেশ দুই ধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশ। ১৪১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৫তম। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লজিস্টিক পারফরম্যান্স সূচক প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। ১৬০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০০তম।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নানা ধরনের কর্মসূচি নিচ্ছে সরকার। কিন্তু বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো বেশ খারাপ। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের আইসিটি উন্নয়ন সূচকে ১৪৭তম। একই সংস্থার গ্লোবাল সাইবার নিরাপত্তা সূচকে ১৭৫টি দেশের মধ্যে ৭৮তম।
জাতিসংঘের আরেক সংস্থা আঙ্কটাড প্রকাশ করে ই-কমার্স সূচক। ১৫১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ আছে মাঝারি অবস্থানে, ৮৮তম। জাতিসংঘের আরেকটি সংস্থা অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ক বিভাগের (ইউএনডিএসএ) ই-গভর্নমেন্ট উন্নয়ন সূচকে প্রথম ১০০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নেই। ১৯৩ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১১৫তম।
সুখ সূচক যেমন আছে, তেমনি ক্ষুধা সূচকও আছে। গত অক্টোবর মাসে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক সংস্থা কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইডের বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে (হাঙ্গার ইনডেক্স) বাংলাদেশ খারাপ দেশের একটি, ১১৯ দেশের মধ্যে অবস্থান ৮৬তম।
আবার অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সুখ বাড়ে কি না—এ জন্য সুখ সূচক প্রকাশ করে জাতিসংঘের সংস্থা টেকসই উন্নয়ন সলিউশন নেটওয়ার্ক। সেখানে বাংলাদেশ তলানির দেশগুলোর একটি। ১৫৬টি দেশের মধ্যে ১২৫তম। শান্তি সূচকেও ভালো নেই বাংলাদেশ। ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস প্রকাশিত বিশ্ব শান্তি সূচকে ১৬৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ হলো ১০১তম।
প্রগতির পথে হাঁটতে হলে নতুন নতুন উদ্ভাবন লাগবে। ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি সংস্থা বিশ্ব উদ্ভাবন সূচক প্রকাশ করে থাকে। সেখানে বাংলাদেশ ১২৯টি দেশের মধ্যে ১১৬তম।
এবার আসি দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান কেমন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল প্রকাশিত বিশ্ব সূচকে বাংলাদেশ এখন ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪৯তম। গত কয়েক বছরে এই সূচকে কিছুটা উন্নতি হলেও একসময় বাংলাদেশ একটানা পাঁচ বছর ছিল শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। অন্যদিকে ট্রেস ইন্টারন্যাশনাল নামের আরেকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রকাশ করে বিশ্ব ঘুষ সূচক। এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ খারাপ, ২০০ দেশের মধ্যে ১৮২তম।
এ ছাড়া যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) প্রকাশ করে গণতন্ত্র সূচক। তাদের তালিকায় বাংলাদেশ আছে ‘হাইব্রিড রেজিম’ অবস্থানে। এটি হচ্ছে স্বৈরতান্ত্রিক ও ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক অবস্থার মাঝামাঝি অবস্থান। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের অধিকার প্রশ্নেও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক ২০১৮’-এ ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬তম।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (বিআইডি) সদস্য শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নারীর ক্ষমতায়নে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। মানবসম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সূচকে ক্রমান্বয়ে উন্নতি হচ্ছে। সর্বক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা তৈরি করতে পারলে অর্থনীতির সব সূচকেই বাংলাদেশ আরও ভালো করবে। যেমন সুদের হার নির্ধারণ করে নয়, বাজারভিত্তিক করতে হবে। প্রতিযোগিতা থাকলে জবাবদিহি তৈরি হবে।’