উৎপাদন খাতে ঋণের সুদ এক অঙ্কে নামছে
>ব্যাংকমালিকেরা ২০১৮ সালে ঋণের সুদ ৯ শতাংশ করার ঘোষণা দিয়ে বিভিন্ন সুবিধা নেন, কিন্তু সুদহার কমাননি।
উদ্যোক্তারাই উল্টো চাপে পড়বেন বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
সরকারের চাপে উৎপাদন খাতে ঋণের সুদহার কমিয়ে এক অঙ্কে (১০ শতাংশের কম) নির্ধারণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী জানুয়ারি থেকে নতুন সুদহার কার্যকরের নির্দেশনা থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ আজ মঙ্গলবার এই সিদ্ধান্ত নেবে এবং এরপরই তা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হবে বলে জানা গেছে।
ব্যাক খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুদহার এক অঙ্কে নামানো হলে উৎপাদন খাতের উদ্যোক্তারাই সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বেন। কারণ, তহবিল খরচ বেশি হওয়ায় ব্যাংকগুলোর পক্ষে এখনই ৯ শতাংশ সুদ কার্যকর করা কঠিন। তাই তারা এই খাতে ঋণ দেওয়ায় সতর্কতা অবলম্বন করবে। এ জন্য তাদের আমানতের সুদের হার কমাতে হবে। ফলে ব্যাংক খাতে আবারও তারল্যসংকট তৈরি হতে পারে। আবার বৈদেশিক ব্যবসাতেও খরচ বেড়ে যেতে পারে। সব মিলিয়ে ভাবমূর্তির সংকটে পড়বে ব্যাংকগুলো।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে আমরা সুদের হার নির্ধারণের চেষ্টা করেছিলাম। তাতে ফল উল্টো হয়েছে। ভারত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অনেক দেশও এমন চেষ্টা করেছে। কেউ টেকসই করতে পারেনি। বর্তমান বিশ্ববাণিজ্যে টিকে থাকতে সুদহার বাজারভিত্তিক হওয়াই কাম্য। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও তা-ই চায়।’
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘উৎপাদন খাত ও ভোক্তা ঋণে একই ধরনের ঝুঁকি। সে জন্য একই ঝুঁকি নিয়ে ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশে ঋণ দেবে না। বিনা ঝুঁকির সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করলেও সাড়ে ৮ শতাংশ সুদ মিলছে। তাই উৎপাদন খাতের ব্যাংকঋণ প্রাপ্তির সুযোগ কমে আসবে। যার ফলে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছি, তাও বাধাগ্রস্ত হতে পারে।’
জানা গেছে, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকমালিকদের চাপে ব্যাংক কোম্পানি আইনে বেশ কিছু পরিবর্তন আনে সরকার, যাতে একই পরিবার থেকে ৪ জনের পরিচালক হিসেবে টানা ৯ বছর মেয়াদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ তৈরি হয়। এরপরই ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদে আমানত ও সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণের ঘোষণা দেয় ব্যাংকমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। তবে সেটা ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এর মধ্যে ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার কথা বলে ব্যাংকমালিকেরা গত দেড় বছরে আরও অনেক সুবিধা নিয়েছেন। কিন্তু সুদহার তাঁরা কমাননি।
সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে ১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামানকে প্রধান করে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি সুদহার কমানোর জন্য বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। সেই সুপারিশ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদ আজ সিদ্ধান্ত নিলে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
ওই কমিটির সদস্য অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত প্রথম আলোকে বলেন, ‘কৃষিঋণের মতো উৎপাদন খাতে মেয়াদি ও চলতি মূলধন ঋণে আমরা এক অঙ্কের সুদহার কার্যকরের সুপারিশ করেছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটা তদারক করবে।’
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা গতকাল সোমবার বলেন, চাপে পড়ে এক অঙ্কের সুদহার নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। পর্ষদের অনুমোদন সাপেক্ষে তা করা হবে, যাতে একা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর দায় না আসে। তবে এর পরিণতি কী হবে, তা দেখতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুদহার কমাতে কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে।’ তিনি ছুটিতে থাকায় পর্ষদে আলোচনার বিষয়টি জানেন না বলে জানান।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে মূল্যস্ফীতির হার ও বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে উৎপাদন খাতের বড়, মাঝারি মেয়াদি ও চলতি মূলধন ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। ওই সময়ে ব্যাংকগুলোও নিজেরা আমানতের সুদহার সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ নির্ধারণ করে।
এদিকে ব্যাংকগুলো বলছে, ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে অনেক ব্যবসায়ী মন্দায় পড়েন। আবার মূল্যস্ফীতি ও সুদহার অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি তেমনটা নয়, বরং ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিলে ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি জোরদার হলে এমনিতেই সুদহার কমে আসবে।
জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইনগতভাবে সুদহার নির্ধারণ করতে পারে না। এটা অবৈধ হবে। এতে মূল উদ্দেশ্য সাধন হবে না, বরং ঋণ বিতরণ আরও কমবে। এখন উচিত আইনকানুন প্রয়োগ করে খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।