২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

এক দশকেই পাল্টে গেছে ইস্পাতশিল্প

ইস্পাতশিল্পে এখন ব্যবহার হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। বিএসআরএমের কারখানা। ছবি: সৌরভ দাশ
ইস্পাতশিল্পে এখন ব্যবহার হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। বিএসআরএমের কারখানা। ছবি: সৌরভ দাশ

৬০ গ্রেডের রড বাজারজাত করতে এক দশক আগেও প্রচারণায় মুখর থাকত ইস্পাত কোম্পানিগুলো। এই মানের রডের কথা এখন প্রচারণায় রাখছে না কেউ। রাখবেই বা কেন? এক দশক ধরে ইস্পাতশিল্পে উৎপাদনের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে একের পর এক নতুন ও উচ্চশক্তির বিশেষায়িত রড।

এ অঞ্চলে ইস্পাতশিল্পের যাত্রা শুরুর প্রায় ৫৬ বছর পর্যন্ত ৪০ ও ৬০ গ্রেড—এই দুই মানের রড তৈরি হতো কারখানাগুলোতে। সেখানে গত এক দশকে এসেছে পাঁচ-ছয় রকমের উচ্চশক্তির রড। ২০০৮ সাল থেকেই আন্তর্জাতিক মানের (আইএসও) রড তৈরিতে যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয় এই খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে। এমনকি, নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে যুক্তরাজ্যে রডের নমুনা নিয়ে ‘ফ্যাটিগ টেস্টও’ (মান পরীক্ষা) করিয়ে নিচ্ছে শীর্ষস্থানে থাকা বিএসআরএম।

শুধু পণ্যের উৎপাদনে বৈচিত্র্য নয়, উৎপাদনেও রূপান্তর ঘটেছে ভেতরে-ভেতরে। ইস্পাত খাতের ইতিহাস শুরুর তিন দশক ছিল সনাতন পদ্ধতির। তিন দশক পর বিএসআরএমসহ দুটি কারখানা শুরু করে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ইস্পাত–পণ্য উৎপাদন। তাতেও খুব বেশি দিন আটকে থাকেননি উদ্যোক্তারা। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির নতুন নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হচ্ছে এই খাতে। এবার তো শুধু নতুনই নয়, জিপিএইচ বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে রড উৎপাদনে, যেখানে স্ক্র্যাপ থেকে দুই-আড়াই ঘণ্টায় তৈরি হবে রড।

শিল্পের রূপান্তর আছে কাঁচামাল ব্যবহারেও। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া চিটাগাং স্টিল মিলস জোগান দিত বিলেটের। আমদানিও হতো। মধ্যবর্তী কাঁচামাল ব্যবহার করে রড উৎপাদনে মূল্য সংযোজন খুব বেশি হতো না। সেটিও নিজেদের করে নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। প্রায় এক বছর ধরে বিলেট আমদানি হচ্ছে না। রড উৎপাদনের জন্য বিলেট কারখানা করেছেন উদ্যোক্তারা। এখন প্রাথমিক কাঁচামাল পুরোনো লোহা গলিয়ে প্রথমে বিলেট তৈরি হচ্ছে। সেই বিলেট উত্তপ্ত করে রড উৎপাদন হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় কারখানাগুলোতে।

এই পরিবর্তনকে কীভাবে দেখছেন বা কেন এই পরিবর্তন, এমন প্রশ্নে ইস্পাত খাতের বিশ্লেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের চেয়ারম্যান মো. সেলিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, এক দশক ধরে ভারী নির্মাণকাজ শুরু হওয়া এবং মানুষের সচেতনতার কারণেই ইস্পাতশিল্পে এই পরিবর্তন অনিবার্য ছিল। উদ্যোক্তারাও জেনে গেছেন, বাজারে টিকে থাকতে হলে এর বিকল্প নেই। সনাতন পদ্ধতিতে তৈরি করা গ্রেডহীন রড বা সাধারণ মানের রড আর চলবে না। এই পরিবর্তনে দুটো ইতিবাচক দিক রয়েছে, বড় প্রকল্পে এখন দেশীয় রড ব্যবহৃত হচ্ছে। তাতে বিদেশ থেকেও আমদানি করতে হচ্ছে না, বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হচ্ছে।

ইস্পাতশিল্পে এমন পরিবর্তনের পেছনে দেশীয় উদ্যোক্তাদের সক্ষমতার চিত্রই উঠে এসেছে। বাংলাদেশে এখন যে বিশ্বমানের স্থাপনা হচ্ছে, সুউচ্চ ভবন হচ্ছে, উপকূলীয় এলাকায় টেকসই স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলছে, সে জন্য বিদেশ থেকে রড আমদানি করতে হচ্ছে না। বিদেশিরাই পরীক্ষা করে এখানকার কারখানায় তৈরি রডই ব্যবহার করছে এসব স্থাপনায়। তাতে বাংলাদেশের রড স্বীকৃতি পাচ্ছে আন্তর্জাতিক মানেও।

ইস্পাতশিল্পে এই পরিবর্তন যদি না হতো, তাহলে কী হতো? তার নজিরও আছে। আড়াই দশক আগের যখন যমুনা বহুমুখী সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়, তখন কিন্তু দেশীয় কোম্পানিগুলো রড সরবরাহ করতে পারেনি। সে সময় যে মানের রড ব্যবহার হয়েছিল যমুনা সেতুতে, তা উৎপাদন হতো না দেশীয় কারখানায়। বেলজিয়াম থেকেই সরাসরি আমদানি করা হয়েছিল এই মানের রড। বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে এই রড আমদানি করতে হয় তখন। এখন যমুনা সেতুর চেয়ে আরও উচ্চমানের স্থাপনায় ব্যবহৃত হচ্ছে দেশীয় রড।

পরিবর্তনে এগিয়ে যারা

যাত্রা শুরুর পর থেকে এ অঞ্চলে ইস্পাতশিল্পের বয়স এখন ৬৭ বছর। তবে ১৯৫২ সালে যাত্রা শুরুর প্রায় চার দশক ধরে খুব একটা পরিবর্তনের ঢেউ লাগেনি এই শিল্পে। নব্বই দশক থেকে স্বয়ংক্রিয় কারখানা চালু হলেও সনাতন পদ্ধতির কারখানাও ছিল বাজারের বড় অংশজুড়ে। ক্রেতাদের মধ্যে মানের বিষয়ে তেমন নজর ছিল না। বিশেষ করে এক দশক ধরে এ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন নিজেদের স্থাপনার নিরাপত্তার জন্য মানের সঙ্গে আপস করছে না কেউ। তাতেই মানহীন রডের বাজার ক্রমে গুটিয়ে আসছে।

ইস্পাত খাতের একটি কোম্পানির জরিপে দেখা যায়, ২০১২ সালেও মানহীন রড উৎপাদন হতো বার্ষিক ১০ লাখ টন। প্রায় ৩৩ শতাংশ বাজার দখল করেছিল মানহীন রড। জাহাজ ভাঙা শিল্পের প্লেট সরাসরি উত্তপ্ত করে এসব রড উৎপাদন হতো। এখন তা নেমে এসেছে ৫ শতাংশের নিচে। মানহীন রড শুধু ছোটখাটো নির্মাণকাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এখন।

ইস্পাত খাতে পরিবর্তনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে প্রথম প্রজন্মের কোম্পানি বিএসআরএম। নতুন নতুন উচ্চশক্তির পণ্য এসেছে এই কোম্পানির হাত ধরে। এখন আবুল খায়ের, কেএসআরএম, রহিম স্টিল, জিপিএইচ, আনোয়ার ইস্পাতের মতো কোম্পানিগুলোও উচ্চশক্তির পণ্য উৎপাদন করছে। এই তালিকায় আছে বন্দর স্টিল, আরএসআরএম, বায়েজিদ স্টিলসহ অনেক কোম্পানি।

বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএসআরএম গ্রুপ সব সময় পণ্যের গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা করছে। পণ্যের উন্নয়ন না করলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সুযোগ নেই। বড় বড় প্রকল্পে বিএসআরএম গ্রুপের রডের ব্যবহারই প্রমাণ করে, গুণগত মানে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে কোম্পানিটি। এরপরও আমরা প্রতিনিয়ত পণ্যের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি।’ তিনি জানান, ভূমিকম্প সহনীয়, উপকূলীয় এলাকার টেকসই স্থাপনা নির্মাণ, বহুতল স্থাপনার মতো বিশেষায়িত কাজে ব্যবহারের জন্য সব ধরনের রডই তাঁরা উৎপাদন করছেন।

রড তৈরির মধ্যবর্তী কাঁচামাল বিলেট উৎপাদনের ক্ষেত্রেও আছে কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা। ১৯৯৬ সালে দেশের বিলেট তৈরির সবচেয়ে বড় কারখানা গড়ে তোলে বিএসআরএম গ্রুপ। এখন শীর্ষস্থানে থাকা কোম্পানিগুলো নিজেদের বিলেট নিজেরাই উৎপাদন করছে। আবার দেশীয় কারখানার উৎপাদিত বিলেট বেচাকেনা হচ্ছে দেশের বাজারেও। তাতে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে না বিলেট। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিলেট আমদানি হয়েছিল প্রায় ১৭ লাখ টন। ধারাবাহিকভাবে তা কমে গত অর্থবছরে নেমে ২০ হাজার টনে। এ অর্থবছরের চার মাসে কোনো বিলেটই আমদানি হয়নি।

রড তৈরি । এখন বাজারজাত করার অপেক্ষায়–সৌরভ দাশ
রড তৈরি । এখন বাজারজাত করার অপেক্ষায়–সৌরভ দাশ

বিলেটে তো স্বয়ংসম্পূর্ণ হলো। উৎপাদনের প্রযুক্তিতেও বড় পরিবর্তন নিয়ে নিয়ে এসেছেন উদ্যোক্তারা। ‘ইনডাকশন ফার্নেস’ বা আনয়ন চুল্লির পর ২০০৯ সালে আবুল খায়ের নিয়ে আসে ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস পদ্ধতিতে রড উৎপাদনের কারখানা। সর্বশেষ জিপিএইচ নিয়ে এসেছে ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেসের আরও সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। শিগগিরই এই প্রযুক্তিতে সরাসরি পুরোনো লোহা থেকে তৈরি হবে রড। পুরোনো লোহা গলিয়ে বিলেট তৈরি করে তা উত্তপ্ত থাকা অবস্থায় রড তৈরি করা হবে কারখানাটিতে।

জিপিএইচ ইস্পাতের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমাস শিমুল প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপত্তার জন্য মানুষ এখন স্থাপনা নির্মাণে গুণগত মানের পণ্য চায়। ভবিষ্যতে গুণগত মানে সবচেয়ে ভালো রডই বেছে নেবেন ক্রেতারা। সর্বোচ্চ গুণগত মানের পণ্য তৈরি করতে হলে দরকার আধুনিক প্রযুক্তি। বিনিয়োগ বেশি হলেও জিপিএইচ রড উৎপাদনে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তিই স্থাপন করেছে।

একক খাতের বড় বাজার

ইস্পাতের দুই ধরনের পণ্য রয়েছে। একটি হলো লং স্টিল বা রড, চ্যানেল ও অ্যাঙ্গেল। আরেকটি হলো ফ্ল্যাট স্টিল বা ঢেউটিন, পাইপ ও ইস্পাতের পাত। ইস্পাতের এসব পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বা সিংহভাগই হলো রড। কাঁচামাল আমদানির ভিত্তিতে দেখা যায়, ২০১৮ সালে বাজারে ইস্পাত–পণ্যের সরবরাহ ছিল ৬৯ লাখ টন। এর সিংহভাগই বা ৫৫ লাখ টনই ছিল লং স্টিল বা রড, অ্যাঙ্গেল ও চ্যানেল। বাকি ১৪ লাখ টন ছিল ফ্ল্যাট স্টিল। ২০১৭ সালে বাজারে রডের সরবরাহ ছিল ৪৭ লাখ টন। টনপ্রতি ৬০ হাজার টাকা ধরে গত বছরে রডের বাজারের আকার ছিল ৩৩ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, দেশে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ইস্পাত–পণ্য রড উৎপাদনের কারখানা আছে ৪২টি। সনাতন পদ্ধতির কারখানার সংখ্যা এক দশকে ২৫০টি থেকে কমে ১০০–এর নিচে নেমেছে। সব কারখানা মিলিয়ে বার্ষিক রড, চ্যানেল, অ্যাঙ্গেলসহ লং স্টিল পণ্য উৎপাদন সক্ষমতা ৮০ লাখ টন।

এত কারখানার মধ্যে মানসম্পন্ন রডের বাজারে পাঁচজনের হাতে আছে ৬৮ শতাংশ বাজার। এই পাঁচজন হলো বিএসআরএম, আবুল খায়ের, কেএসআরএম, রহিম স্টিল ও জিপিএইচ। ন্যূনতম ১০ হাজার মেট্রিক টন রড উৎপাদন করে এমন কারখানার সংখ্যা ৫২ টি। দেশে উৎপাদিত রডের ৯৮ শতাংশ এসব কারখানার হাতে।

ব্যবহার বাড়ছে

সব ধরনের ইস্পাত–পণ্য বিবেচনায় নিয়ে ইস্পাতের জনপ্রতি ব্যবহার হিসাব করে ওয়ার্ল্ড স্টিল অ্যাসোসিয়েশন। বৈশ্বিক এই সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে বিশ্বে জনপ্রতি গড়ে ইস্পাত ব্যবহারের পরিমাণ ছিল প্রায় ২০৩ কেজি। গত বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ২২৪ দশমিক পাঁচ কেজিতে। সংগঠনটির হিসাবে বাংলাদেশের পাঁচ বছর আগে দেশে ইস্পাতের জনপ্রতি ব্যবহার ছিল ১৭ কেজি। বাংলাদেশ স্টিল অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ কেজিতে।

রপ্তানি

ইস্পাত খাতের মধ্যে রড থেকে রপ্তানি আয় খুবই কম। রড রপ্তানি হয় ভারতের ত্রিপুরা, আসামসহ কয়েকটি রাজ্যে। তাও অনিয়মিত। রপ্তানি কেন বাড়ছে না জানতে চাইলে এই খাতের উদ্যোক্তারা জানান, ভারতের কয়েকটি রাজ্যে রড রপ্তানির বড় সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এসব রাজ্যে রড রপ্তানিতে এখনো অনেক অশুল্ক বাধা রয়ে গেছে। এসব অশুল্ক বাধা দূর করা গেলে ত্রিপুরা, মিজোরামসহ ভারতের কয়েকটি রাজ্যে রড রপ্তানি বাড়বে।

সব মিলিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই ইস্পাতশিল্পের বড় পরিবর্তন এসেছে। আর তা হয়েছে দেশীয় উদ্যোক্তাদের হাত ধরেই।