বিপুল উৎপাদন, বিশাল আমদানি, তবু পেঁয়াজের দাম চড়া
দেশে বিপুল পরিমাণে পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে। আমদানিও প্রচুর। দুইয়ে মিলে বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ চাহিদার চেয়ে ৪৩ শতাংশ বেশি। তবু দামটা মানুষের নাগালে নেই।
সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী দেশে এবার পেঁয়াজের মোট সরবরাহ হয়েছে ৩৪ লাখ ৬৬ হাজার টন। বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ টন। সেই হিসাবে উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ৬৬ হাজার টন। এতে দাম কম থাকারই কথা, যদিও তা হয়নি।
ব্যবসায়ীরা সরবরাহের এই তথ্য-উপাত্তকে উড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁরা বলেন, উৎপাদনের হিসাবে ঘাপলা আছে। দেশে এত পেঁয়াজ থাকলে অবশ্যই বাজারে ব্যাপকভাবে আসত। কারণ, দাম এখন বেশ ভালো।
ঢাকার মানুষকে এখন দেশি পেঁয়াজ ৫৫-৬০ টাকা ও ভারতীয় পেঁয়াজ ৫০-৫৫ টাকা কেজিতে কিনতে হচ্ছে। অথচ পবিত্র ঈদুল আজহার আগে সব ধরনের পেঁয়াজ ৪০ টাকা কেজির মধ্যে ছিল। বিক্রেতাদের দাবি, বাজারে দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ কম। অন্যদিকে ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বেশি। তাই দেশিটারও দাম চড়া।
জানতে চাইলে পুরান ঢাকার শ্যামবাজারভিত্তিক আমদানিকারক মো. আবদুল মাজেদ বলেন, দেশে উৎপাদন যা হয়েছে, তার খুব বেশি অবশিষ্ট নেই। এ কারণে ভারতের ওপর দাম নির্ভর করছে। দেশটিতে পেঁয়াজের দাম অনেক বেড়ে গেছে।
দেশে পেঁয়াজ উৎপাদনের পরিসংখ্যান তৈরি করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। ডিএইর ১৭ জুলাইয়ের এক হিসাব অনুযায়ী দেশে এবার পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৬ লাখ ২০ হাজার টন, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৩ লাখ টন বেশি। অবশ্য এখন তাদের ওয়েবসাইটে উৎপাদনের নতুন হিসাব উল্লেখ করা হচ্ছে। সেখানে উৎপাদন দেখানো হচ্ছে ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে আমদানি হয়েছে (ঋণপত্র নিষ্পত্তি) ১০ লাখ ৯২ হাজার টন। এতে মোট সরবরাহ দাঁড়ায় প্রায় ৩৪ লাখ ২০ হাজার টন। অবশ্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব বিবেচনায় নিলে মোট সরবরাহ দাঁড়ায় ৩৪ লাখ ৬৬ হাজার টন। এনবিআর বলছে, গত অর্থবছরে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ১১ লাখ ৩৬ হাজার টন।
বিবিএসের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পেঁয়াজ উৎপাদনের হিসাব এখনো চূড়ান্ত হয়নি। অবশ্য বিগত বছরগুলোতে পেঁয়াজের উৎপাদনের হিসাব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিবিএস ও ডিএইর হিসাবে ব্যাপক ফারাক ছিল। বিবিএসের হিসাবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৭ লাখ টনের কিছু বেশি পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছিল। অন্যদিকে ডিএইর হিসাবে উৎপাদনের পরিমাণ ২৩ লাখ টনের বেশি।
জানতে চাইলে বিবিএসের কর্মকর্তারা গত রোববার প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা জেলায় জেলায় নিজেদের কার্যালয়ের মাধ্যমে উৎপাদনের তথ্য সংগ্রহ করেন। অন্যদিকে ডিএইর সরেজমিন শাখার পরিচালক মো. আবদুল মুঈদ বলেন, ‘আমাদের জনবল অনেক বেশি। মাঠপর্যায় থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করে হিসাব তৈরি করা হয়।’ তিনি বলেন, উৎপাদনের পর কৃষকের ঘরে থেকে অথবা বাজারে সরবরাহের সময় অনেক পেঁয়াজ নষ্ট হয়।
কৃষি পরিসংখ্যান নিয়ে হিসাবের এই পার্থক্য নতুন নয়। গ্রহণযোগ্য পরিসংখ্যান তৈরি করতে চাল, গম, ভুট্টাসহ মোট ছয়টি প্রধান ফসলের হিসাব করা হয় সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়নের মাধ্যমে।
জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, সবাই মিলে একটি গ্রহণযোগ্য পরিসংখ্যান তৈরি করা উচিত। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ অনেক বেশি হলে দামের এত ওঠানামা হওয়ার কথা নয়। সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে বাণিজ্যসচিব বলেন, ‘আমরা পর্যবেক্ষণ জোরদার করেছি। তদারকি করা হচ্ছে, যাতে বাজারে কোনো কারসাজি না করা যায়।’
সহজ যোগাযোগের কারণে পেঁয়াজের ৯৯ শতাংশই আমদানি হয় ভারত থেকে। মাঝেমধ্যে ভারতে দাম অনেক বেড়ে গেলে কিছু পেঁয়াজ চীন, মিসর, পাকিস্তান ও তুরস্ক থেকে আসে।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ছগীর আহমেদ বলেন, পেঁয়াজে আমদানিনির্ভরতা কমানোর উপায় হলো উৎপাদন বাড়ানো। পেঁয়াজ চাষে উৎসাহ দেওয়ার জন্য কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। ভরা মৌসুমে কৃষকের কথা বিবেচনা করে প্রয়োজনে শুল্ক-কর আরোপ করে আমদানিও নিরুৎসাহিত করতে হবে।