পাবনার স্কয়ার এখন কেনিয়ার বুকে
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের নজর এখন বিদেশে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলা। সে লক্ষ্যে এরই মধ্যে আফ্রিকার দেশ কেনিয়ায় কারখানা তৈরি করছে কোম্পানিটি। আগামী বছরের মাঝামাঝিতে এ কারখানায় উৎপাদন শুরু করতে চায় স্কয়ার ফার্মা। এর মাধ্যমে কেনিয়াসহ পূর্ব আফ্রিকার ছয়টি দেশের ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার বা সাড়ে ২৫ হাজার কোটি টাকার ওষুধের বাজার ধরতে চায় তারা। কেনিয়ায় কারখানা করতে প্রাথমিকভাবে ৮০ লাখ ডলার বা ৬৮ কোটি টাকার মূলধন বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর বাইরে কারখানা তৈরিতে ঋণ নেওয়া হয়েছে আরও ১ কোটি ২০ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে কেনিয়ায় কারখানা তৈরিতে কোম্পানির মোট বিনিয়োগ ২ কোটি ডলার বা ১৭০ কোটি টাকায় দাঁড়াবে বলে জানালেন স্কয়ার ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা তপন চৌধুরী।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত স্কয়ার ফার্মা ১৯৯৫ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওতে ১০ লাখ শেয়ার ছেড়ে ৯০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছিল। সে সময় ১০০ টাকা অভিহিত মূল্যের বা ফেসভ্যালুর এ শেয়ারের জন্য অধিমূল্য বা প্রিমিয়াম নেওয়া হয় ৮০০ টাকা। সেই ৯০ কোটি টাকার মধ্যে ৫০ কোটি দিয়ে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে গড়ে তোলা হয় স্কয়ার ফার্মার বিশাল কারখানা। বাকি ৪০ কোটি টাকায় তৈরি হয় স্কয়ার টেক্সটাইল। এটিও ২০০২ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়।
সর্বশেষ ২০১৭–১৮ অর্থবছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্কয়ার ফার্মার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৫৭৮২ কোটি টাকার। সদ্য বিদায়ী ২০১৮–১৯ অর্থবছরের মুনাফা যোগ হলে এ সম্পদের পরিমাণ বেড়ে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াবে। কোম্পানি তাদের সম্পদ মূল্যের হিসাব করেছে ক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে। বর্তমান বাজারমূল্যে হিসাব করা হলে কোম্পানিটির সম্পদমূল্য ২১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। অথচ ১৯৫৮ সালে মাত্র ২০ হাজার টাকা নিয়ে যাত্রা শুরু করে কোম্পানিটি। সেই ২০ হাজার টাকার কোম্পানি এখন পরিণত হয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকার কোম্পানিতে। স্কয়ার ফার্মার স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরী। বর্তমানে কোম্পানিটিকে বিশ্ব পরিসরে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁর সন্তান ও নাতি–নাতনিরা। স্কয়ার ফার্মার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তিন প্রজন্ম।
শুরুর কথা
গত বুধবার বিকেলে কোম্পানিটির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে মহাখালীর স্কয়ার সেন্টারে বসে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হয় তপন চৌধুরীর। তিনি বলেন, তাঁর প্রয়াত বাবাসহ (স্যামসন এইচ চৌধুরী) চার বন্ধু মিলে গড়ে তোলেন স্কয়ার ফার্মা। বাকি তিনজন অংশীদার ছিলেন রাধারমণ রায়, পরিতোষ সাহা ও হারুনুর রশিদ। তাঁদের শেষ দুজন ছিলেন চিকিৎসক। চারজনই ৫ হাজার টাকা করে বিনিয়োগ করেন। চারজনের সমান বিনিয়োগ বলে নাম ঠিক হয় স্কয়ার। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর রাধারমণ রায় ও পরিতোষ সাহা তাঁদের মালিকানার অংশ ছেড়ে দেন। হারুনুর রশিদের মালিকানার অংশ এখনো রয়ে গেছে তাঁর সন্তানের হাতে। চার বন্ধু মিলে কোম্পানিটি গড়ে তুললেও নেতৃত্বে ছিলেন স্যামসন এইচ চৌধুরী। শুরুতে পাবনায় নিজ বাড়ির কাছেই কোম্পানির কারখানা করা হয়। শুরুতে স্কয়ার ফার্মা শিশুদের জন্য সিরাপজাতীয় ওষুধ তৈরি করত। ধীরে ধীরে সময়ের সঙ্গে কোম্পানির পরিসরও বড় হতে থাকে।
তপন চৌধুরী আরও বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের পর ১৯৭৪ সালে এসে বহুজাতিক কোম্পানি জনসন অ্যান্ড জনসনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় স্কয়ার। ওই সময় দেশের ওষুধের বাজারে একচেটিয়া প্রভাব ছিল বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর। জনসনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর এ দেশে কোম্পানিটির ওষুধ উৎপাদন শুরু করে স্কয়ার। তাতে ওষুধের বাজারে শক্ত ভিত তৈরি হয় স্কয়ারের। ১৯৮২ সালে এসে এরশাদ সরকারের সময় বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে দেশীয় কোম্পানিগুলোর চুক্তি ও সনদ বাতিল করে দেয়। পাশাপাশি দেশের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধ বা এসেনশিয়াল ড্রাগসের একটি তালিকা তৈরি করে। তত দিনে বিদেশি কোম্পানি জনসনের জন্য ওষুধ তৈরি করতে গিয়ে স্কয়ারের সক্ষমতা অনেক বেড়ে যায়। সেই সক্ষমতা দিয়েই ’৮৩–’৮৪ সালের দিকে অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি শুরু করে স্কয়ার। এরপর আমাদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
তপন চৌধুরী জানান, ব্যবসা শুরুর আগে তাঁর বাবা নৌবাহিনীতে চাকরি করতেন। পাবনায় নিজ এলাকায় পারিবারিকভাবে ওষুধের ফার্মেসি ছিল। বাবা চাকরি ছেড়ে সেই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কারণেই হয়তো ওষুধের ব্যবসায় যুক্ত হতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
বর্তমানে বিশ্বের ৪২টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে স্কয়ার। এর মধ্যে এশিয়ার ১৯টি দেশ, আফ্রিকার ১৩টি, ওশেনিয়া অঞ্চলের ৩টি, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার ৬টি এবং যুক্তরাজ্যের বাজারে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ রপ্তানি করা হয়। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই বছর স্কয়ার ১৪৫ কোটি টাকার ওষুধ রপ্তানি করেছে। এ ক্ষেত্রে আগের বছরের চেয়ে প্রায় সাড়ে ৪ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
শেয়ারবাজারে স্কয়ার
বছর বছর বিনিয়োগকারীদের মুনাফা বিতরণে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা কোম্পানিগুলোর একটি স্কয়ার ফার্মা। দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) হাতেগোনা যে কয়টি ব্লুচিপস বা উন্নত মানের কোম্পানি রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম এটি। ২০১৩–১৪ থেকে ২০১৭–১৮—এই পাঁচ অর্থবছরে গড়ে প্রতিবছর নগদ ও বোনাস মিলিয়ে সাড়ে ৪৪ শতাংশ হারে লভ্যাংশ বিতরণ করেছে কোম্পানিটি। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের বর্তমান বাজারমূল্য ২৫০ টাকার বেশি। অভিহিত মূল্য ১০০ টাকাকে বিবেচনায় এ বাজারমূল্য দাঁড়ায় আড়াই হাজার টাকায়। কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির ২৪ বছর চলছে।
স্কয়ার ফার্মা ডিএসইতে তালিকাভুক্ত বাছাই করা সেরা ৩০ কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস–৩০ সূচকে অন্তর্ভুক্ত। ভালো মুনাফা ও লভ্যাংশ বিতরণে ধারাবাহিকতা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। তাই কোম্পানি প্রোফাইলে এটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে।