২২ শতাংশ করদাতাকে দিতে হয়েছে ঘুষ
শুল্ক-কর বিভাগে যেকোনো কাজে ঘুষ দিতে হয়—এটি বহু দিনের অভিযোগ। এই অভিযোগের সত্যতার চিত্র উঠে এল খোদ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক জরিপে। এনবিআর নিজেই করদাতাদের সন্তুষ্টি নিয়ে সেই জরিপ করেছে। সেই জরিপে ঘুষ দিয়ে কাজ করানোর কথা বলেছেন অনেক করদাতা। কোথাও কম, কোথাও বেশি। সবখানেই ঘুষ দিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন তাঁরা।
ঘুষ দেওয়ার কথা সবচেয়ে বেশি জানিয়েছেন বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) করদাতারা। এলটিইউতে দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও তাদের মালিকদের শুল্ক-কর নথি থাকে। এনবিআর জরিপ অনুযায়ী, ভ্যাট রিটার্ন দেওয়ার ক্ষেত্রে এলটিইউর ২২ শতাংশ করদাতা ঘুষ দিয়ে কাজ করিয়েছেন।
নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের আগে বাস্তব পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে এনবিআরের ভ্যাট অনলাইন প্রকল্প থেকে এই জরিপ করেছে। সম্প্রতি জরিপটি প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে ১ হাজার ৫৫ জন ভ্যাটদাতা ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মতামত জানতে চাওয়া হয়। এলটিইউর পাশাপাশি ১১টি ভ্যাট কমিশনারেটের ১ হাজার ৫৫টি প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা জরিপে অংশ নেন। এনবিআর মনে করছে, নতুন আইনের আওতায় ভ্যাট অনলাইন–ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু হলে এ ধরনের হয়রানি কমে যাবে।
ঘুষ দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, বাস্তব অবস্থা আরও ভয়াবহ। যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, বাস্তবে এর চেয়ে বেশি ঘুষ দেওয়া–নেওয়া হয়। পদে পদে ঘুষ দিতে হয়। তাঁর মতে, ভ্যাটের অনলাইনে রিটার্ন জমার ব্যবস্থা হলে ঘুষের প্রকোপ কিছু কমবে। এখন রিটার্ন দিতে যে হয়রানির শিকার হতে হয়, তা–ও কমে যাবে।
দেশের সবচেয়ে বড় করদাতারা এলটিইউর নিবন্ধিত করদাতা। জরিপে ৫০টি প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা অংশ নেন। তাঁরা দেশের বড়, প্রভাবশালী ও শিক্ষিত ব্যবসায়ী। জরিপে ভ্যাট রিটার্ন জমার সময় কী ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়, তা জানতে চাওয়া হয়। ৪৩ শতাংশ করদাতা জানিয়েছেন, সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, হিসাব–নিকাশের কাগজপত্রই নেননি ভ্যাট কর্মকর্তারা। আর ৩৯ শতাংশ জানিয়েছেন, ‘লাল ফিতা’র দৌরাত্ম্য খুব বেশি। ২২ শতাংশ করদাতাকে ভ্যাট রিটার্ন জমার সময় ঘুষ দিতে হয়েছে।
নতুন আইনে মূসক বা ভ্যাট রেয়াত নেওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভ্যাট রেয়াত নিতে এত দিন সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয়েছে ভ্যাটদাতাদের। জরিপ বলছে, ভবিষ্যতে হয়রানি ও নিরীক্ষার ভয়ে ভ্যাট রেয়াত নেন না। আবার অনেক সময় টাকার পরিমাণ অল্প হওয়ায় অনেকে অনাগ্রহ দেখান। কীভাবে ভ্যাট রেয়াতের আবেদন করতে হয়, তা জানেন না। জরিপের ফল অনুযায়ী, বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই ভ্যাটের রেয়াতের আবেদন করে তা পাননি। শুধু এলটিইউর করদাতারা জানিয়েছেন, ৯৪ শতাংশ ভ্যাট রেয়াতের আবেদন নাকচ হয়েছে। যাঁরা ভ্যাট রেয়াতের টাকার জন্য আবেদন করেছেন, টাকা হাতে পেতে তাঁদের কমপক্ষে ৩০ দিন সময় লেগেছে। এই টাকা পেতে এক-চতুর্থাংশ করদাতাকে ‘বাড়তি টাকা’ খরচ করতে হয়েছে।
এদিকে ভ্যাট কর্মকর্তাদের সততা, সহযোগিতা, দক্ষতা ও ভ্যাট মূল্যায়ন বিষয়ে জরিপে অংশ নেওয়া বড় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, তাঁরা মোটামুটি সন্তুষ্ট। এই সন্তুষ্টির মাত্রা ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ।
নতুন ভ্যাট আইনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন এনবিআরের সাবেক সদস্য রেজাউল হাসান। জরিপটি করার সময় তিনি ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘুষ-হয়রানি কমাতে নতুন ভ্যাট আইনটি অনলাইন–ব্যবস্থাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেভাবে ভ্যাট অনলাইন–ব্যবস্থার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তা থেকে বেশ সরে গেছে এনবিআর। যেমন অনলাইনেই ভ্যাট নিবন্ধনের ব্যবস্থার পরিবর্তন করা হয়েছে। আগে অনলাইনেই আবেদনের অনুমোদন দেওয়া হতো, এখন সরেজমিন প্রতিষ্ঠান দেখে নিবন্ধন দেওয়া হবে। এতে হয়রানি ও অনৈতিক লেনদেনের সুযোগ বাড়বে। আবার অনলাইনে রিটার্ন জমার সময় ভ্যাটের পুরো টাকার পরিমাণ লিখলেই হতো। এখন কোন খাতে কত ভ্যাট, তা আলাদা করে লিখতে হবে। এতে হয়রানি বাড়বে।
বড় করদাতাদের পাশাপাশি ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ, পশ্চিম ও পূর্ব ভ্যাট কমিশনারেটের ৪৯৫ জন ভ্যাটদাতা এই জরিপে অংশ নেন। তাঁদের কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, ভ্যাট কার্যালয়ের লাল ফিতার দৌরাত্ম্য। তাঁদের ৩৫ শতাংশের বেশি এই অসুবিধার কথা জানিয়েছেন। তবে ৬ শতাংশের বেশি ব্যবসায়ীকে ঘুষ দিয়ে ভ্যাট রিটার্ন জমা দিতে হয়েছে। ঢাকা এসব ব্যবসায়ী ভ্যাট রেয়াতের আবেদন করে মাত্র ৯ শতাংশ টাকা পেয়েছেন। টাকা ফেরত পেতে তাঁদের সময় লেগেছে দেড় মাসের মতো।
ভ্যাট–সংক্রান্ত হয়রানি কমাতে এনবিআরকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে জরিপ প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হয়রানিমুক্ত ভ্যাট ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কর্মকর্তা–কর্মচারীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। এ ছাড়া অনলাইনে ভ্যাট রিটার্ন ও ভ্যাটের টাকা পরিশোধের সুযোগ তৈরি করা হলে হয়রানি কমে যাবে।
জরিপ প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের করব্যবস্থার উন্নতি হলেও এখনো কর আদায়ে কম উদ্যোগী দেশ। আবার এ দেশের করদাতারা দেশ ও সমাজের প্রতি তাঁদের নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে কর দেন না।