টেরাকোটা টাইলসে টাকা পাচার
আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে মাটির তৈরি টেরাকোটা টাইলস রপ্তানি করেছে এসবি এক্সিম নামের ঝিনাইদহের একটি প্রতিষ্ঠান। এখন সেই রপ্তানির বিপরীতে ২০০ কোটি টাকা দেশে আসছে না। যদিও ওই রপ্তানি বিল কিনে প্রতিষ্ঠানটিকে ১৯০ কোটি টাকা দিয়েছে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। ব্যাংকটির মালিকানায় রয়েছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
এখন সেই রপ্তানির টাকাও দেশে আসছে না, ফলে ১৯০ কোটি টাকাও শোধ হচ্ছে না। আসবেই বা কীভাবে, বিদেশি যেসব ব্যাংক থেকে রপ্তানি আদেশ এসেছিল, তার চারটিরই নিজ দেশে কার্যক্রম নেই, পরিচালনায় অনুমোদনও নেই। বৈশ্বিক ভাষায় যা ‘শেল ব্যাংক’ নামে পরিচিত। এসব ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেনে বৈশ্বিক ও দেশীয় নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে।
দেশে ও বিদেশে সেই অর্থের সুবিধাভোগী গ্রাহকের নাম শাহজাহান বাবলু। এসবি পুণ্য গ্রুপের চেয়ারম্যান তিনি। গ্রুপের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘শাহজাহান বাবলু বাংলাদেশের একজন বিজনেস মেগনেট।’ দুবাই ও সিঙ্গাপুরে তাঁর পাঁচ ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকেও তাঁর বিদেশে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
বাংলাদেশে আগে ‘ভুয়া বিদেশি কোম্পানি’র নামে অর্থ পাচারের ঘটনা উঠে এলেও এবার প্রথম ‘ভুয়া বিদেশি ব্যাংক’-এর খবর পাওয়া গেল।
বাংলাদেশের অর্থ পাচারের তদন্ত সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এ নিয়ে অনুসন্ধান শেষে বলেছে, শাহজাহান বাবলু ব্যাংকের সহায়তায় বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। আবার রপ্তানি বিলের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন ১৯০ কোটি টাকা। রপ্তানির বিপরীতে সরকারি নগদ সহায়তা নেওয়ারও চেষ্টা হয়েছিল।
শাহজাহান বাবলু ও কমার্স ব্যাংকের জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও দুর্নীতি দমন কমিশনে চিঠি দিয়েছে বিএফআইইউ।
বিএফআইইউর প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান এ নিয়ে বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে তথ্য দেওয়া। আমরা দিয়েছি। বাকি দায়িত্ব এখন তাদের।’
এদিক ঝিনাইদহ থেকে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন, শহরের বিসিক এলাকায় গত সেপ্টেম্বরে কারখানা করেছে এসবি এক্সিম। এ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত দেড় লাখ টাইলস উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ পিস রপ্তানি হয়েছে।
এসব নিয়ে এসবি গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহজাহান বাবলু গতকাল বুধবার রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘১ কোটি ডলার এসেছে। বাকি টাকা জুলাইয়ের মধ্যে চলে আসবে। ক্রেতাদের সঙ্গে যে ব্যাংকের যোগাযোগ, সেই ব্যাংক থেকে টাকা এসেছে। এতে তো কোনো সমস্যা নেই। কাতারে আমাকে একটা কোম্পানি প্রতি মাসে সম্মানী দেয়, সেই টাকা দুবাইয়ে এনে দোকান খুলেছি। অনুমোদন নিয়ে রপ্তানির ১০ শতাংশ টাকাও আমি বিনিয়োগ করেছি।’
বেশি দামে ক্রয় আদেশ
এসবি গ্রুপকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের যে তিনটি প্রতিষ্ঠান টেরাকোটা টাইলস কেনার আদেশ দেয়, এর মধ্যে দুটির মালিকানায় বাংলাদেশিরা। এর মধ্যে হেন্ডিওয়্যার ইন্টারন্যাশনাল জেনারেল ট্রেডিংয়ের কর্ণধার বাংলাদেশের মোহাম্মদ রাফিউদ্দিন ও সাবিয়া আফরিন। আবার আল মাওয়াদ জেনারেল ট্রেডিংয়ের কর্ণধারও মোহাম্মদ রাফিউদ্দিন। প্রতিষ্ঠান দুটি চামড়াজাত পণ্য ও পশুর লোম নিয়ে ব্যবসার জন্য দেশটিতে নিবন্ধিত হলেও বাংলাদেশ থেকে টাইলস আমদানি করেছে বলে ব্যাংকের নথিপত্রে বলা হচ্ছে। আরেকটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে মিলস্ট্রিম গ্লোবাল জেনারেল ট্রেডিং। এ তিনটি প্রতিষ্ঠানই ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৭২টি ঋণপত্রের মাধ্যমে ৪ কোটি ১২ লাখ ৫২ হাজার ডলারের (৩৫০ কোটি টাকা) টাইলস আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলে। এসবি গ্রুপ যে টাইলস রপ্তানি করে, তার প্রতিটির দাম ধরা হয়েছে ১০ ডলার।
>১০০ গুণ বেশি দামে রপ্তানি
বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশি
রপ্তানির ২০০ কোটি টাকা আটকা
ব্যাংক দিয়েছে আরও ১৯০ কোটি টাকা
বিদেশি চার ব্যাংকই অস্তিত্বহীন (শেল ব্যাংক)
দুবাই ও সিঙ্গাপুরে গ্রাহকের ৫ ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান
উদ্যোক্তা ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চিঠি
তদন্ত প্রতিবেদনে এ নিয়ে বলা হয়েছে, ১০০ গুণ পর্যন্ত বেশি দাম দেখিয়ে টাইলস রপ্তানি করা হয় মূলত বিল ক্রয় করে ব্যাংক থেকে বেশি টাকা বের করতে।
অস্তিত্বহীন বিদেশি ব্যাংক
বিদেশি চারটি ব্যাংক থেকে এসবি এক্সিম থেকে টাইলস কিনতে কমার্স ব্যাংকে ঋণপত্র আদেশ আসে। এ ব্যাংক চারটি নিজের দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না। নিজ দেশে তাদের শাখাও নেই। কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণেও নেই এসব ব্যাংক। এমন ব্যাংকগুলো বৈশ্বিকভাবে ‘শেল ব্যাংক’ নামে পরিচিত।
বৈশ্বিক অর্থ পাচার প্রতিরোধ সংস্থা ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো শেল ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করা পুরোপুরি নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ ব্যাংকেরও এ নিয়ে কড়াকড়ি নির্দেশনা রয়েছে।
সূত্রমতে, চার বিদেশি ব্যাংকের মধ্যে সুইস ক্রেডিট ক্যাপিটাল ২০০৯ সালে যুক্তরাজ্যে কিম ক্যাপিটাল নামে নিবন্ধন নিলেও ২০১৮ সালে বন্ধ হয়ে যায়। এ সময়ে প্রতিষ্ঠানটি সাতবার ঠিকানা ও তিনবার নাম পরিবর্তন করে। এরপরও সেই প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণপত্র এসেছে।
আর পয়েন্ট ব্যাংক কোনো ব্যাংকই না, মূলধন মাত্র ১০০ পাউন্ড। ইউরো এক্সিম ব্যাংক ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের সেন্ট লুসিয়ায় ও প্যান প্যাসিফিক ব্যাংক আফ্রিকার গাম্বিয়ায় নিবন্ধিত হলেও নিজ দেশে তাদের কোনো কার্যক্রম নেই।
২০৯টি বিলের মধ্যে ৬৫টি বিলের টাকা দেশে এলেও প্রায় এক বছর ধরে বাকি বিলের টাকা আসছে না। পণ্য রপ্তানির চার মাসের মধ্যে আয় দেশে আসার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
টাকা এসেছে দুবাই থেকে
এসবি এক্সিমের কয়েকটি রপ্তানি নথি পর্যালোচনায় বিএফআইইউ দেখেছে, পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলেছে আরব আমিরাতের কোম্পানি, তবে পণ্য রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু রপ্তানি মূল্য এসেছে দুবাই থেকে। ফলে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে যে এতে আন্তর্জাতিক ব্যবসার সব নিয়মকানুন লঙ্ঘন করা হয়েছে। কারণ, যে দেশে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলবে, সে দেশেই পণ্য রপ্তানি হওয়ার কথা। আবার রপ্তানি মূল্যও আসবে সে দেশ থেকে।
আবার ৬৫টি বিলের অর্থ এসেছে দুবাইয়ের আবুধাবি কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে। আর সব সুইফট বার্তা প্রেরণ করা হয়েছে বিশেষ ২০২ কোড ব্যবহার করে, যাতে অর্থ প্রেরণকারীর তথ্য গোপন থাকে।
দুবাই ও সিঙ্গাপুরে ব্যবসা
এসবি পুণ্য গ্রুপের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, দুবাই ও সিঙ্গাপুরে কমপক্ষে পাঁচ ধরনের ব্যবসা রয়েছে। এর মধ্যে দুবাইয়ে রয়েছে পুণ্য জুয়েলারি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে পুণ্য ফুড স্টাফ ট্রেডিং ও পুণ্য জেনারেল ট্রেডিং। আর সিঙ্গাপুরে রয়েছে পুণ্য গোল্ড অ্যান্ড ডায়মন্ড পিটিই লিমিটেড ও পুণ্য সুপারমার্কেট পিটিই লিমিটেড।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সিঙ্গাপুরের বিজনেস ডিরেক্টরি ঘেঁটে দেখা গেছে, পুণ্য গোল্ড অ্যান্ড ডায়মন্ড ২০১৮ সালের ২ আগস্ট সিঙ্গাপুরের ব্যবসার জন্য নিবন্ধন নেয়। আর পুণ্য সুপার মার্কেটের নিবন্ধন নেওয়া হয় ২০১৭ সালের ৩ মার্চ। আগে এর নাম ছিল পিআইইউ ট্রেডিং লিমিটেড। পুণ্য সিঙ্গাপুরের মান অনুযায়ী সুপারমার্কেট বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দুটোরই ঠিকানা দেওয়া হয়েছে গে লেং এলাকার গ্র্যান্ড ভিউ সুইটস।
বাংলাদেশের আইনে এখন পর্যন্ত যে কয়টা প্রতিষ্ঠান বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন পেয়েছে, সেই তালিকায় এসবি গ্রুপ নেই।
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
বিএফআইইউ তদন্ত করে বলেছে, এসবি এক্সিমের রপ্তানি বিল ক্রয়সংক্রান্ত নথিতে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল, গ্রাহক খেলাপি। এরপরও বিল ক্রয়ে সম্মতি দেন তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আর কিউ এম ফোরকান, অতিরিক্ত এমডি জাফর আলম, ডিএমডি কাজী রিয়াজুল করিমসহ কয়েকজন। কিউ এম ফোরকান এখন কমার্স ব্যাংক সিকিউরিটিজের এমডি।
এ নিয়ে ব্যাংকের বর্তমান এমডি আবদুল খালেক খান, অতিরিক্ত এমডি ও ডিএমডির সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা গত রোববার জানান, গ্রাহক ইতিমধ্যে ১১০ কোটি টাকা দেশে এনেছেন। ৪৩ কোটি টাকা ঋণ শোধ করেছেন।
কাজী রিয়াজুল করিম বলেন, ‘কোনো শেল ব্যাংকের বিল কেনা হয়নি। ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিকভাবে নামকরা।’ তিনি ব্যাংকটির প্রধান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ পরিপালন কর্মকর্তাও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, গ্রাহক টাকা পাচার করতে ও ব্যাংক থেকে টাকা বের করতে নতুন এ কৌশল নিয়েছেন। এটা অর্থ পাচার ও লোপাটের নতুন পদ্ধতি। এত বেশি দামে রপ্তানি হওয়া পণ্যের বিল ব্যাংক কীভাবে কিনল।