মৌলভীবাজারে স্থানীয় লিচু নজর কাড়ছে ক্রেতাদের
ফলের দোকান, ভ্যানগাড়ি ও ফুটপাতে বেতের ঝুড়িতে এখন স্থানীয় লিচু দাপটের সঙ্গে নিজেদের জাহির করছে। এবার স্থানীয়ভাবে লিচুর ফলনও ভালো হয়েছে। দামও অনেকটা ক্রেতাদের নাগালে। পথচলতি ক্রেতাসাধারণ মৌসুমের শুরুতেই হাত বাড়িয়ে নিচ্ছেন নজরকাড়া মৌসুমি এই ফলকে। আশা করা হচ্ছে, এবার সারা জেলায় ৩০ কোটি টাকার লিচু কেনাবেচা হবে।
স্থানীয়ভাবে লিচু উৎপাদনের ক্ষেত্রে এ বছর বাদুড়, কাঠবিড়ালি ও বানরের উৎপাত ছাড়া বড় কোনো বিপর্যয় হয়নি। ঝড়ঝাপটার কবলেও খুব একটা পড়েনি। এতে লিচুচাষিরা খুশি। আরও কিছুদিন পরে অন্য জাতের ও দেশের নানা প্রান্ত থেকে লিচু আসা শুরু হবে।
লিচুচাষি, মৌসুমি ফল বিক্রেতা ও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বৈশাখ মাসের শেষ দিক থেকে মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন পাহাড়ি টিলা এলাকা থেকে জেলা শহর ও ছোট–বড় হাট–বাজারে স্থানীয় লিচু আসা শুরু হয়। পাইকারি ও খুচরা লিচু বিক্রেতারা শহরের বিভিন্ন ফুটপাত, পথের মোড় এবং মৌসুমি ফল বিক্রির নির্দিষ্ট স্থানে ভ্যানগাড়ি, বেতের ঝুড়ি ও ডালাভর্তি নজরকাড়া লিচু নিয়ে বসেন। সরেজমিনে দেখা গেছে, কয়েক দিন ধরে মৌলভীবাজার শহরের চৌমোহনা, শমশেরনগর সড়ক, কোর্ট রোড, পশ্চিম বাজার, কুসুমবাগ এলাকা, চাঁদনী ঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় লিচু বিক্রি হচ্ছে। এখন বোম্বে ও স্থানীয় জাতের লিচু বাজারে এসেছে। আকার ও ধরনভেদে ১০০ লিচু ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আরও কিছুদিন পর আসবে বেদানা, কাঁঠালি, চায়না-৩ ও বারি-২ জাতের লিচু। এগুলো বাজারে এলে লিচুর দামও কমবে। একসময় জেলার নির্দিষ্ট কিছু পাহাড়ি এলাকায় লিচু চাষ হলেও এখন বিক্ষিপ্তভাবে সারা জেলাতেই কমবেশি লিচুর আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মৌসুমি এই ফল পরিবহন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন অনেক মানুষ। সকাল থেকেই দেখা যায় জেলা শহরের বিভিন্ন সড়ক ধরে ঠেলাগাড়ি, ভ্যানগাড়ি, সিএনজিচালিত টমটমসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে করে লিচু নিয়ে আসছেন বিক্রেতারা।
জেলার অন্যতম লিচুচাষি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কাগাবলা ইউনিয়নের বুরুতলার একটি লিচুবাগানের মালিক হুমায়ূন কবীর আজ সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার ফলন খুব ভালো হয়েছে। একদম বাম্পার ফলন। আমার বাগানের ৭৬টি গাছ পাইকারের কাছে ২ লাখ ২১ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। পাইকাররা নিজেদের দায়িত্বে গাছ থেকে ফল পেড়ে নিচ্ছেন। পাঁচটা গাছ রেখেছি নিজেরা খাওয়ার জন্য, আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনদের দেওয়ার জন্য।’ হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘বাদুড়, বানর, কাঠবিড়ালি ছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই। বাগান পাহারা দেওয়ার জন্য লোক আছে। পাশাপাশি বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছি। রাতেও দিনের মতো আলো থাকে বাগান এলাকায়।’
স্থানীয় লোকজন জানান, প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত খুচরা লিচু বিক্রেতাদের ভিড় লেগে থাকে লিচুবাগান এলাকায়। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে খুচরা বিক্রেতারা আসেন। তাঁরা ভ্যানগাড়িসহ বিভিন্ন যানে লিচু নিয়ে যায়।
মৌলভীবাজার শহরের চৌমোহনা এলাকার মৌসুমি খুচরা ফল বিক্রেতা আসিক মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বর্ষিজুরা এলাকা থেকে লিচু পাইকারি কিনে আনি। ১০০ লিচু ১৫০ থেকে ১৭০ টাকায় বিক্রি করছি।’
ক্রেতা শৈলেন রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ১০০ লিচু কিনেছি ১৫০ টাকায়। স্থানীয় লিচু হলেও স্বাদ ভালো, মিষ্টি আছে। দামও সহনীয়।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজার কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলার পাহাড় বর্ষিজুরা, জগন্নাথপুর, শ্যামেরকোনা, কাগাবলা ইউনিয়নের বুরুতলা, কমলগঞ্জ উপজেলার কালাছড়া, শমশেরনগর, রাজনগরের টেংরা, কুলাউড়া উপজেলার চাতলা, জুড়ী ও বড়লেখার টিলাভূমিতে লিচুর চাষ হচ্ছে। সারা জেলায় ছোট–বড় ৪০ থেকে ৫০টির মতো লিচুবাগান আছে। তবে বাগানের বাইরে বাড়ি ও অন্যান্য ফলের সঙ্গেও এখন লিচুর আবাদ বাড়ছে। কৃষি বিভাগ প্রতিবছর কৃষকদের মধ্যে লিচুগাছের চারা বিতরণ করছে। তবে অনেকেই অন্যান্য ফলের গাছের নিচে চারা গাছ রোপণ করছেন। নয়তো রোপণ করেই ফেলে রাখছেন। প্রয়োজনীয় যতœ করছেন না। না হলে লিচুর উৎপাদন জেলায় আরও বৃদ্ধি পেত। এ বছর জেলায় ৩০৫ হেক্টর জমিতে ৪৭ হাজার গাছে লিচু এসেছে। উৎপাদন আশা করা হচ্ছে ১ হাজার ৮৩০ টন, যার বাজারমূল্য প্রায় ৩০ কোটি টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক কাজী লুৎফুল বারী আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার লিচুর ফলন ভালো হয়েছে। এখনো বড় কোনো ঝড় হয়নি। ঝড়ে অনেক সময় ফল ঝরে পড়ে। ডাল ভেঙে পড়ে। অন্যান্য উৎপাতও কম। লিচুচাষিরাও জানিয়েছেন, ফলন ভালো হওয়ায় তাঁরা খুশি। আমরা যেকোনো প্রদর্শনীতে অন্যান্য গাছের সঙ্গে লিচুর চারাও দিই। জেলায় লিচু উৎপাদন বাড়ছে। স্থানীয় লিচু এখন বাজারে বিক্রি হচ্ছে।’