>গ্যাসের দাম বাড়াতে চায় তিতাস, বাখরাবাদ, কর্ণফুলীসহ ছয়টি বিতরণ কোম্পানি। সে জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) শুনানিও করেছে। তবে কোম্পানিগুলো যে হারে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে, তার বিরোধিতা করছেন ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার।
প্রথম আলো: নতুন করে আবার গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিষয়টিকে আপনারা ব্যবসায়ীরা কীভাবে দেখছেন?
মোহাম্মদ আলী খোকন: গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি আমাদের ব্যবসায়ীদের জন্য অত্যন্ত দুঃসংবাদ। সে জন্য গত মঙ্গলবার বিইআরসির গণশুনানিতে প্রথমবারের মতো ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শফিউল ইসলামের পাশাপাশি বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বিটিএমএর পক্ষে আমি ছিলাম। সেখানে তিতাসের কর্মকর্তারা গ্যাসের দাম বাড়ানোর পক্ষে যৌক্তিক কোনো কারণ দেখাতে পারেননি। তাঁরা বারবার তাঁদের শেয়ারহোল্ডারদের মুনাফা দেওয়ার কথা বলেছেন। তখন আমি প্রশ্ন করেছিলাম, আপনাদের পাবলিক শেয়ার কত শতাংশ? তিতাসের পক্ষ থেকে বলা হলো, ২৫ শতাংশ। তার মানে হচ্ছে, ৭৫ শতাংশের মালিক তিতাস গ্যাস। তিতাস ডিভিডেন্ডের মাধ্যমে লাভ নিচ্ছে। আবার গ্যাসের দাম বাড়িয়েও মুনাফা ঘরে তুলছে। এ ছাড়া সঞ্চালন লাইনসহ অন্য যেসব কারণ কোম্পানিগুলো দেখাচ্ছে, তার কোনো যৌক্তিকতা আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। পৃথিবীর কোনো দেশের সরকার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির মতো পরিষেবা (ইউটিলিটি) নিয়ে ব্যবসা করে না। কারণ, সেবাগুলো দিয়ে পরোক্ষভাবে অন্য খাত থেকে লাভ পাওয়া যায়। গত তিন বছরে গ্যাসের দাম ১৩০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। আমাদের নিজস্ব কোনো কাঁচামাল নেই। গ্যাস ও শ্রমই হচ্ছে আমাদের কাঁচামাল। তাই প্রতিযোগিতা করতে হলে ভর্তুকি মূল্যে আমাদের গ্যাস দিতে হবে।
প্রথম আলো: বস্ত্রকলগুলো গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। ক্যাপটিভের জন্য প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৯ টাকা ৬২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা ৪ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। গ্যাসের দাম এত বাড়লে বস্ত্রকলগুলো টিকে থাকতে পারবে?
মোহাম্মদ আলী খোকন: একটা বস্ত্রকলও টিকবে না। হয়তো নিবু নিবু করে জ্বলে একসময় বন্ধ হয়ে যাবে। বর্তমানে অনেক বস্ত্রকল লোকসানে আছে। সুতা উৎপাদনে যে খরচ হচ্ছে, সেই দাম পাওয়া যাচ্ছে না। গ্যাসের দাম বাড়ানোর যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তাতে প্রতি কেজি সুতায় ৫ শতাংশ উৎপাদন খরচ বাড়বে। সেই বাড়তি টাকা কে দেবে? বস্ত্র ও পোশাক খাত বন্ধ হলে প্রথম আঘাতটা আসবে ব্যাংক খাতে। পোশাক ও বস্ত্র খাতে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে বিভিন্ন ব্যাংকের। দ্বিতীয় আঘাত আসবে কর্মসংস্থানে। কারণ, পোশাক ও বস্ত্র মিলে সরাসরি ৫৫ লাখ মানুষ জড়িত। তা ছাড়া রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেলে উন্নয়নের চাকা বন্ধ হয়ে যাবে।
প্রথম আলো: আপনি বললেন, গ্যাসের দাম বাড়লে বস্ত্রকল টিকবে না। তাহলে শীর্ষ রপ্তানি খাত পোশাকশিল্পের কী অবস্থা হবে?
মোহাম্মদ আলী খোকন: গত অর্থবছর ৩ হাজার কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। সেই পোশাক তৈরির জন্য আমরা বস্ত্র খাত থেকে দেড় হাজার কোটি ডলারের কাপড় সরবরাহ করেছি। সেটি যদি না থাকে তাহলে তো মূল্য সংযোজন কিছুই থাকবে না। আমাদের শিল্প যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে পোশাকশিল্পের মালিকেরা লিড টাইমও (পণ্য উৎপাদন থেকে জাহাজীকরণ পর্যন্ত সময়) রক্ষা করতে পারবেন না। তখন অর্ডারগুলো ভিয়েতনাম, চীন, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশে চলে যাবে। আর আমাদের বস্ত্র খাতের মূল কাঁচামাল গ্যাস। আমাদের মনে হচ্ছে, বস্ত্র ও পোশাক খাত ধ্বংস করার জন্য বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ না-কেউ কাজ করছে। সরকার হয়তো সেটি বুঝতে পারছে না। সরকার চাইছে দেশটা উন্নত হোক। কিন্তু আমি দুটি অশুভ সংকেত দেখতে পারছি। ব্যাংক খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়ে গেছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে প্রকৃত উদ্যোক্তাদের উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে। অন্যদিকে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেটি হলে পোশাক ও বস্ত্র খাত হুমকির মধ্যে পড়ে যাবে।
প্রথম আলো: প্রতিবারই গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হলে আপনারা বলেন, শিল্প টিকে থাকতে পারবে না। তারপরও গ্যাসের দাম বাড়ে। আপনারাও টিকে থাকেন।
মোহাম্মদ আলী খোকন: গত এক বছরে বস্ত্র খাতের ৩০০ কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়েছে। তারা সবাই আমাদের বিটিএমএর সদস্য। আমাদের কারখানাগুলোতে ১ কোটি ১০ লাখ স্পিন্ডল (সুতা তৈরির যন্ত্র) থাকলেও চালু আছে মাত্র ৮০ লাখ স্পিন্ডল।
প্রথম আলো: আপনি কি বলতে চাইছেন, শুধু গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে কারখানাগুলো বন্ধ হয়েছে?
মোহাম্মদ আলী খোকন: শুধু গ্যাসের দাম বাড়ানো না। ব্যাংকে ঋণখেলাপি হওয়ার কারণেও বন্ধ হয়েছে অনেক কারখানা। গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে বাড়তি চাপে পড়ছে কারখানাগুলো। উৎপাদন খরচ বাড়ছে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। রপ্তানি ছেড়ে স্থানীয় বাজারের জন্য ব্যবসা করতে এসেও ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৪ শতাংশ অগ্রিম আয়করের কারণে টিকতে পারছে না কেউ।
প্রথম আলো: গত ১০ বছরে ৬ বার গ্যাসের দাম বেড়েছে। বছর বছর গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের কারণে শিল্প খাতে কী ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়ে। আপনাদের প্রস্তাব কী?
মোহাম্মদ আলী খোকন: আমরা কিন্তু ছয় মাস কিংবা এক বছরের জন্য শিল্পকারখানা করি না। যখন কারখানা করি, তখন ব্যাংকে আমাদের পরবর্তী ১০ বছরের ব্যবসায়িক পূর্বাভাস দিতে হয়। সেখানে গ্যাস, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য খরচ হিসাব করে কোন বছর কত মুনাফা হবে, তার বিস্তারিত থাকে। ফলে বছর বছর গ্যাসের দাম বাড়লে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। গত বছর আমরা সরকারকে বলেছিলাম, এলএনজি আসছে। আপনারা আস্তে আস্তে দাম বাড়িয়ে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যান। কিন্তু রাতারাতি গ্যাসের দাম এত বাড়ানো হলে শিল্প তো বন্ধ হয়ে যাবে। ব্যাংকের ঋণ নেওয়া আছে। তিন-চার বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। বর্তমানে বস্ত্র খাতের অবস্থা খুবই নাজুক। গ্যাসের দাম না বাড়িয়ে সমন্বয় করা হোক। অথবা এলএনজি আনার পর সরকার যখন নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস দিতে পারবে, তখন বাড়ানো হোক। গত মঙ্গলবার গ্যাস-সংকটের কারণে আমার কারখানা সাত ঘণ্টা বন্ধ ছিল। বরাদ্দ অনুযায়ী গ্যাস দিতে পারছে না কোম্পানিগুলো, কিন্তু সে জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে না। আমরা বহুদিন ধরে বলছি ইবিসি মিটার লাগানোর জন্য। বাতাস দিয়ে গ্যাসের দাম নিয়ে যাচ্ছে কোম্পানিগুলো। এটা কোনোভাবেই ব্যবসা নয়, বরং ব্যবসায়ীদের জিম্মি করা। অবৈধ লাইন তিতাসের লোকজন জড়িত না থাকলে হতো না। অবৈধ লাইনগুলো বন্ধ করা গেলে পাইপলাইনে গ্যাসের সংকট থাকবে না বলেই আমার ধারণা।