পোশাকের ব্যবসা বাড়ছে

টানা কয়েক দিনের শ্রমিক অসন্তোষের পর কাজে ফিরেছেন পোশাকশ্রমিকেরা। গতকাল দুপুরে আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানার সুয়িং সেকশনে।  ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
টানা কয়েক দিনের শ্রমিক অসন্তোষের পর কাজে ফিরেছেন পোশাকশ্রমিকেরা। গতকাল দুপুরে আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানার সুয়িং সেকশনে। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
>

• পোশাক খাতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ
• দশ বছরে রপ্তানি বেড়েছে আড়াই গুণ
• মোট পণ্য রপ্তানিতে হিস্যা বৃদ্ধি ৫%
• গত বছর নতুন বাজারে রপ্তানি বেড়েছে ২৬%
• কারখানার ১৯ শতাংশই হয়েছে গত পাঁচ বছরে
• পরিবেশবান্ধব কারখানা হয়েছে ৮০টি
• বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে নতুন ক্রয়াদেশ আসছে

তৈরি পোশাকের ব্যবসা গত ১০ বছরে প্রায় আড়াই গুণ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে পোশাক রপ্তানি ১৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে, যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। দেশের সামগ্রিক পণ্য রপ্তানিতে পোশাকের হিস্যাও বেড়েছে। ১০ বছর আগে মোট রপ্তানির ৭৯ শতাংশ ছিল পোশাক, এখন সেটি ৮৩ শতাংশের বেশি।

২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড এবং পরের বছর রানা প্লাজা ধসের কারণে পোশাক রপ্তানিতে সাময়িক মন্দা নামলেও আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। গত পাঁচ বছরে কর্মপরিবেশ উন্নয়নে প্রচুর কাজ হওয়ায় ক্রেতাদের আস্থা ফিরেছে। ফলে গত কয়েক বছরের তুলনায় অধিকাংশ কারখানারই ক্রয়াদেশ বেড়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের কারণেও অনেক মার্কিন ক্রেতা বাংলাদেশমুখী হচ্ছেন। ইতিমধ্যে তাঁদের বাড়তি ক্রয়াদেশ পেতে শুরু করেছে কারখানাগুলো।

রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি পোশাক খাতের ব্যবসাও সুসংহত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও কানাডার মতো প্রচলিত বাজারের ওপর নির্ভরশীলতাও কিছুটা কমিয়ে এনেছে বাংলাদেশ। চীন, ব্রাজিল, জাপান, রাশিয়া, তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া, ভারতের মতো নতুন বাজারে রপ্তানি বাড়ছে। গত বছর মোট পোশাক রপ্তানির সাড়ে ১৬ শতাংশ নতুন বাজার থেকে এসেছে। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গত সাড়ে পাঁচ বছরে ১ হাজার ২৫০ কারখানা বন্ধ হয়েছে। তবে নতুন এসেছে ৩০০-৩৫০ কারখানা। এসব কারখানার উৎপাদন ক্ষমতা বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর চেয়ে বেশি। বর্তমানে মোট কারখানার ১৯ শতাংশ রানা প্লাজা ধসের পর। নতুন কারখানার মধ্যে আছে ৮০টি পরিবেশবান্ধব কারখানা। এ ছাড়া ১০ বছর আগে পোশাকশিল্পে কর্মরত ছিলেন ৩৫ লাখ শ্রমিক। এখন এই শিল্পে কর্মরত আছেন ৪০ লাখ শ্রমিক।

আবার সরকারও পোশাক খাতকে নানা ধরনের নীতি সহায়তা এবং নানা ধরনের শুল্ক ছাড় দিয়ে আসছে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে রপ্তানিতে উৎসে কর দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ২৫ শতাংশ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।

ব্যবসা ভালো থাকলেও নতুন মজুরিকাঠামো নিয়ে টানা ৯ দিন আন্দোলন করেছেন পোশাকশ্রমিকেরা। আন্দোলনের মুখে ছয়টি গ্রেডে ১৫ থেকে ৭৪৭ টাকা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার গঠিত ত্রিপক্ষীয় কমিটি।

পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ নাছির গতকাল মঙ্গলবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, মজুরিসহ অন্যান্য খরচ বেড়েছে। কিন্তু পোশাকের দাম বাড়াচ্ছেন না ক্রেতারা। ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানার টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে যাবে।

মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, প্রতিযোগী দেশের তুলনায় আমাদের শ্রমিকের দক্ষতা বাড়ছে না। পোশাকের মূল্য ধারাবাহিকভাবে কমিয়ে দিচ্ছেন ক্রেতারা। আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে না। কয়েক দিন পরপরই আন্দোলন-সংগ্রাম হচ্ছে। সেগুলো থামাতে গিয়ে আমরা নিজেদের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারছি না। মালিক ও শ্রমিক একজন আরেকজনের দিকে আঙুল তুলছে। এই দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে তৃতীয় পক্ষ।’

তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশ দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে। সবার ওপরে চীন। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, গত ২০০৮-০৯ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি ছিল ১ হাজার ২৩৪ কোটি মার্কিন ডলার। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সেই রপ্তানি বেড়ে ৩ হাজার ৬১ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। ১০ বছরে রপ্তানি বেড়েছে ১৪৮ শতাংশ বা ২ দশমিক ৪৮ গুণ।

এদিকে চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রপ্তানি বেড়েছে ১৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এ সময় ইইউভুক্ত দেশগুলোতে পোশাক রপ্তানি ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ বেড়েছে। একইভাবে কানাডায় ২০ শতাংশ এবং নতুন বাজারে ৩৬ শতাংশ পোশাক রপ্তানি বেড়েছে।

দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির শীর্ষ বাজার ছিল যুক্তরাষ্ট্র। গত বছর জার্মানি সেই অবস্থান দখল করে নিয়েছে। তবে রানা প্লাজা ধসের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানি কমছিল। গত বছরের জানুয়ারিতে এই বাজারেও ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এই বাজারে রপ্তানি বেড়েছে ১৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ বেশি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের সুফল পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। নতুন নতুন ক্রেতা পোশাকের ক্রয়াদেশ নিয়ে আসছেন। পুরোনো ক্রেতারাও ক্রয়াদেশ আগের চেয়ে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাকের রপ্তানি বাড়ছে।

জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘প্রচুর ক্রয়াদেশ আসছে। তবে ক্রেতারা এত কম দাম বলছেন যে সব ক্রয়াদেশ নিতে পারছি না। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তা ছাড়া একসময় ১২০ দিনের লিড বা সময় দিতেন ক্রেতারা। এখন সেটি কমে আসছে ৬০ দিনে। কিন্তু কারখানা থেকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে জাহাজে পণ্য তুলে দিতে ৭-১০ দিন সময় লাগছে।’

এদিকে পোশাকশিল্পের রপ্তানি যেখানে বাড়ছে, সেখানে অন্য রপ্তানি খাতের অবস্থা খুব ভালো নয়। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি গত অর্থবছর থেকেই কমছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেও ১৪ শতাংশ কমেছে। আরেক শীর্ষ খাত পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিও ২৬ শতাংশ কম। চিংড়ি রপ্তানি কমেছে ১৭ শতাংশ।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, গত এক দশকে পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় অর্জন শ্রমিকদের নিরাপত্তার দিক দিয়ে কর্মপরিবেশের উন্নতি। এটি ভাবমূর্তির পুনরুদ্ধারে বড় ভূমিকা রেখেছে। অন্যদিকে সস্তা পোশাকের পাশাপাশি মধ্য ও উচ্চমানের পোশাক তৈরি করছে অনেক কারখানা। ৫ ভাগের ১ ভাগ কারখানা এখন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এতে করে কারখানার উৎপাদনশীলতার পাশাপাশি শ্রমিকের দক্ষতা বেড়েছে। তবে শ্রম অধিকারের অনেক বিষয় এখনো উপেক্ষিত।

সিপিডির এই গবেষক আরও বলেন, ভবিষ্যতে উন্নত প্রযুক্তি ও বড় বিনিয়োগের কারখানাই ব্যবসা করবে। ছোট-মাঝারি কারখানার টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে যাবে। তা ছাড়া পরিবেশদূষণের বিষয়টি সামনের দিনগুলোতে বড় ইস্যু হয়ে আসবে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হয়ে গেলে ২০২৭ সালে ইইউতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে না। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।