দুই বিসিএসের কোনটাতে কতটা এগিয়ে বিজ্ঞানের প্রার্থীরা
দুটি বিসিএসের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এখানে বিজ্ঞান থেকে পাস করে আসা প্রার্থীদের দাপট। তাঁরাই সবচেয়ে বেশি চাকরি পাচ্ছেন। এই দুটি বিসিএস হচ্ছে ৪১ ও ৪৩তম বিসিএস। এই দুই বিসিএসের সার্বিক ফল সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) বার্ষিক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
পিএসসির বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৪১তম ও ৪৩তম বিসিএসে মানবিক বিভাগ থেকে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন। তবে পিএসসি যাঁদের চাকরির জন্য চূড়ান্তভাবে সুপারিশ করেছিল, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিলেন বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। ৪১তম বিসিএসে সুপারিশ করা পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৬ দশমিক ২১ শতাংশ ছিলেন বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। ৪৩তম বিসিএসে সেটি ছিল ৩৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। অবশ্য পিএসসির প্রতিবেদনে প্রকৌশল ও চিকিৎসাবিজ্ঞানকে আলাদা বিভাগ দেখানো হয়েছে। এই দুটি বিভাগকে বিজ্ঞান বিভাগের সঙ্গে যোগ করলে দেখা যায়, ওই দুই বিসিএসে চূড়ান্তভাবে সুপারিশ পাওয়াদের মধ্যে ৬৫ শতাংশের বেশি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী।
পিএসসি সূত্রগুলো জানিয়েছে, একসময় বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা বিসিএসে কম আসতেন। প্রকৌশলীরাও কম আসতেন। কিন্তু গত কয়েকটি বিসিএসে এই হার বেশ বেড়েছে। মানবিকের শিক্ষার্থীরাও আছেন। তবে ব্যবসায় শিক্ষার প্রার্থীরা কম আগ্রহী হচ্ছেন। পরিসংখ্যানও তা-ই বলছে।
৪১তম বিসিএসে বিজ্ঞানে ৩৬ শতাংশের বেশি প্রার্থী চাকরি পেয়েছেন। এ ছাড়া প্রকৌশলী পেয়েছেন প্রায় ১৭ শতাংশ আর চিকিৎসক প্রায়ে ১২ শতাংশ। তাঁরা সবাই বিজ্ঞানের। সেই হিসাবে বিজ্ঞানের প্রার্থী মোট হয় ৬৫ শতাংশ। এ ছাড়া এই বিসিএসে মানবিকে প্রায় সাড়ে ২৩ শতাংশ প্রার্থী চাকরি পেয়েছেন। ব্যবসা শিক্ষায় প্রায় ৯ শতাংশ এবং অন্যান্য ২ দশমিক ৭০ শতাংশ প্রায় চাকরি পেয়েছেন।
প্রায় ৪ চার বছর শেষ হওয়ার পর গত মাসের শেষ দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিলেন ৪১তম বিসিএসের ২ হাজার ৪৫৩ জন ক্যাডার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জানায়, মন্ত্রণালয় গত ২১ মার্চ ৪১তম বিসিএসে ২ হাজার ৪৫৩ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এই বিসিএসে নিয়োগ দিতে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) ২ হাজার ৫২০ জনের নাম সুপারিশ করেছিল। সেখান থেকে প্রজ্ঞাপনে বাদ পড়েছেন ৬৭ জন। সব মিলিয়ে বিজ্ঞপ্তি শুরুর দিন আর প্রজ্ঞাপনের দিনের সঙ্গে যোগদানের দিন হিসাব করলে দেখা যায়, ৪১তম বিসিএসের সব কার্যক্রম শেষ হতে লেগে গেল সাড়ে ৪ বছর।
পাকিস্তান আমলে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক বেশি সিএসপি পাস করতেন। বাংলাদেশ আমলে একটা সময় পর্যন্ত মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের জয়জয়কার ছিল। এখন ক্রমে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী বাড়ছে।
পিএসসি সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ৪১তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পিএসসি। এতে আবেদন করেন চার লাখের বেশি প্রার্থী। ২০২১ সালের আগস্টের শুরুতে ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারির ফলাফল প্রকাশ করা হয়। প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় ২১ হাজার ৫৬ জন উত্তীর্ণ হন। তাঁরা লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ কেন্দ্রে একযোগে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এর ফলাফল প্রকাশিত হয় ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৩ হাজার জন। এরপর ওই বছরের ডিসেম্বরের শুরুর দিকে তাঁদের মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হয়। ২০২৩ সালের ২৬ জুন শেষ হয় ৪১তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা। এরপর গত বছরের ৬ আগস্ট ৪১তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করে পিএসসি। ৪১তম বিসিএসে ২ হাজার ৫২০ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়।
৪৩তমতে বিজ্ঞানের দাপট আরও বেশি
৪৩তম বিসিএসে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী চাকরি পেয়েছেন প্রায় ৬৬ ভাগ। এর মধ্যে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় থেকে আছেন ৩৮ শতাংশের বেশি প্রার্থী, প্রকৌশলী আছেন ২৩ শতাংশের বেশি আর চিকিৎসক আছেন সাড়ে ৪ শতাংশের কিছু বেশি। তাঁরা সবাই বিজ্ঞান বিভাগ থেকে আসা। এ ছাড়া মানবিকের প্রার্থী আছেন প্রায় ২৪ শতাংশ। ব্যবসায় শিক্ষার প্রার্থী আছেন মাত্র ৮ দশমিক ১৮ ভাগ ও অন্যান্য আছেন ২ শতাংশের কিছু বেশি।
গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে ৪৩তম বিসিএসে ২ হাজার ৮০৫ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। সিদ্ধান্ত অনুসারে ২ হাজার ১৬৩ জনকে ক্যাডার পদে ও ৬৪২ জনকে নন-ক্যাডার পদে মোট ২ হাজার ৮০৫ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।
এই বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছিল ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর। সেই হিসাবে সাড়ে তিন বছর চলে গেলেও আটকে আছে চূড়ান্ত নিয়োগের কার্যক্রম। এই বিসিএসে ২ হাজার ১৬৩ ক্যাডার পদের সর্বোচ্চ ৮০৩ জনকে সরকারি কলেজের প্রভাষক পদে সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রশাসন ক্যাডারে ৩০০ জন, পররাষ্ট্র ক্যাডারে ২৫, পুলিশ ক্যাডারে ১০০, কর ক্যাডারে ১০১, তথ্য ক্যাডারে ৪৩ ও সহকারী ডেন্টাল সার্জনে ৭৫ জনকে সুপারিশ করা হয়েছে।
নন-ক্যাডারে ৯ম, ১০ম ও ১২তম গ্রেডে মোট ৬৪২ জনকে বিভিন্ন পদে সুপারিশ করা হয়েছে। নন-ক্যাডারে ৬৪২ জনের মধ্যে সর্বোচ্চ ২৭৪ জনকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে সুপারিশ করা হয়েছে।
গত বছরের ২০ আগস্ট ৪৩তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে পিএসসি। এতে উত্তীর্ণ হন ৯ হাজার ৮৪১ জন। জুলাইয়ে পিএসসি এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করেছিল। ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ কেন্দ্রে ৪৩তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি ৪৩তম বিসিএসের প্রিলিমিনারির ফল প্রকাশিত হয়। এতে উত্তীর্ণ হন ১৫ হাজার ২২৯ প্রার্থী। ৪৩তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এই বিসিএসে বিভিন্ন ক্যাডারে ১ হাজার ৮১৪ কর্মকর্তা নেওয়া হবে। এর মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারে ৩০০ জন, পুলিশ ক্যাডারে ১০০, পররাষ্ট্র ক্যাডারে ২৫, শিক্ষা ক্যাডারে ৮৪৩, অডিটে ৩৫, তথ্যে ২২, ট্যাক্সে ১৯, কাস্টমসে ১৪ ও সমবায়ে ১৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ ছিল।
সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণকেন্দ্রের সাবেক রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, পাকিস্তান আমলে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক বেশি সিএসপি পাস করতেন। বাংলাদেশ আমলে একটা সময় পর্যন্ত মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের জয়জয়কার ছিল। এখন ক্রমে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী বাড়ছে। তার কারণ এখন বুয়েট, মেডিকেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের ভালো ভালো বিষয়ের শিক্ষার্থীরা বিসিএসের প্রতি আগের চেয়ে বেশি আগ্রহী হয়েছেন।