আমার বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার দিনটি
আমাদের বিসিএস প্রিলির তারিখ ছিল ২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর। সকালে ঘুম থেকে উঠে পরিপাটি হয়ে নাশতা না খেয়েই জন্মস্থান দয়াকান্দা থেকে রওনা হলাম। বেরুনোর আগে মা–বাবার কাছে দোয়া চেয়ে নিয়েছিলাম। পোশাক–পরিচ্ছদ ও জুতায় প্রথমত আরাম এবং দ্বিতীয়ত মানের গুরুত্ব দিয়েছিলাম। জামাকাপড় পরিধান করে অস্বস্তি হলে মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। আবার মানসম্মত পোশাক মানসিক অবস্থা ভালো রাখে। তাই আরাম ও মানের সমন্বয় করে নিয়েছিলাম।
দয়াকান্দা থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশাযোগে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার হয়ে ভুলতায় পৌঁছলাম। সঙ্গে মুঠোফোন, এমনকি ঘড়ি বহনে বিধিনিষেধ থাকায় সময়ের সঙ্গে সমন্বয় নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ সৃষ্টি হতে শুরু করল। ভুলতা থেকে বিআরটিসি বাসে কুড়িল বিশ্বরোডে পৌঁছালাম। বাসে আরও পরীক্ষার্থী থাকায় সদ্য পরিচিতদের সঙ্গে সময়টা মন্দ কাটেনি। যদিও দিনটি অন্য যেকোনো দিনের মতোই ছিল। হাই ভোল্টেজ পরীক্ষা থাকায় চারপাশটাকে কেমন যেন অন্যরকম রোমাঞ্চকর লাগছিল।
সরকারি তিতুমীর কলেজে আমার পরীক্ষার কেন্দ্র। বিপত্তিটা বাধল কুড়িল থেকে মহাখালীগামী বাসে ওঠার সময়। সম্ভবত বাসের দরজায় ভাঙা কাচে লেগে বাম হাতের আঙুলের অগ্রভাগ কেটে গিয়েছিল। কথিত আছে, পরীক্ষা বা গুরুত্বপূর্ণ কাজের আগে ধারালো কোনো কিছুর সংস্পর্শে এলে অবচেতনভাবে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সে রকমই ঘটল। আঙুলের অগ্রভাগে রক্তের চাপ অনেক বেশি থাকে। তাই রক্তপাত হচ্ছিল কাটার মাত্রার চেয়ে বেশি। তবে আমি টের পাইনি। জনাকীর্ণ বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে যাচ্ছিলাম। পাশে থাকা এক সহযাত্রী বললেন, ‘ভাই, আপনার হাত থেকে প্রচুর রক্ত পড়ছে।’
পাশে এক পরীক্ষার্থী আপু দাঁড়ানো ছিলেন। তাঁর হাতে টিস্যু ছিল। হাত থেকে রক্ত পড়ছে দেখিয়ে তাঁকে টিস্যু দিতে অনুরোধ করলাম। একটা টিস্যু নিমেষে রক্তে ভিজে গেল। রক্তপাত কমাতে হাত ওপরের দিকে তুলে রাখলাম। পাশের সিট খালি হলো। আমি উপকারী আপুকে বসার সুযোগ দিলাম।
সিটে বসে আপু আরেকটা টিস্যু আমাকে দিলেন। রক্তপাত থামছে না দেখে এক ভাই সিট ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘ভাই, চলন্ত গাড়িতে দাঁড়িয়ে থাকায় আপনার রক্তচাপ বেশি। আপনি না বসলে রক্তপাত থামবে না। প্লিজ, বসেন।’ সেই ভাইকে ধন্যবাদ দিয়ে সিটে বসলাম। মহাখালী এসে ভাইটিকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বাস থেকে নামলাম। অতঃপর ওই আপুকে শুভকামনা জানিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রের দিকে হেঁটে চললাম।
রাস্তায় যেতে ছোট এক প্যাকেট পাউরুটি ও আধা লিটার পানি কিনে নিলাম। কোনো গুরুত্বপূর্ণ মিশনে ভরপেটে যাত্রা করলে মানসিক চাপে বমি হতে পারে। তাই নাশতা না খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু খালি পেটে মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করে না বলে পরীক্ষার আগে ক্ষুধা–তৃষ্ণা নিবারণ করে নিলাম।
পরীক্ষার হলে ঢোকার আগে এক প্যাকেট টিস্যু কিনে নিয়েছিলাম। টিস্যু ও পানি যেকোনো সময় প্রয়োজন হতে পারে। সে জন্য এগুলো হাতের নাগালে রাখলাম। হাত নিচের দিকে রাখা ও দ্রুত হাঁটার প্রতিক্রিয়া হিসেবে আঙুল থেকে আরেক দফা রক্তপাত হলো। হাত পরিষ্কার করে, রক্ত পড়া থামিয়ে সিট খুঁজে নিয়ে শান্ত হয়ে বসলাম। হাতের আঙুল অবশ্য ব্যথায় টনটন করছিল। একটা পেইন কিলার খেলে হয়তো ভালো লাগত।
পরীক্ষক হলে ঢোকার পর কিঞ্চিৎ অস্থিরতা পেয়ে বসতে শুরু করেছিল। সুরা ফাতিহা, সুরা ইখলাস, সুরা নাস, সুরা ফালাক, আয়াতুল কুরসি ও দুরূদ পড়লাম। আল্লাহকে বললাম, ‘হে আল্লাহ, নিজের সামর্থের সর্বোচ্চ প্রয়োগের সক্ষমতা দিও; লোভ সংবরণ করে, না পারা ও সংশয়ী প্রশ্নগুলো ছেড়ে যাওয়ার তৌফিক দিও।’
নিজেকে বললাম, প্রতিযোগিতা আবেগের জায়গা নয়; স্থির থেকে নিজেকে প্রমাণ করার মধ্যেই সফলতা। আল্লাহর অশেষ কৃপায় স্নায়ু একদম স্থিতিশীল হয়ে গেল। জানতাম প্রিলিতে সফল হতে হলে ৪% ভাগ্যবান ও অধিক যোগ্য পরীক্ষার্থীর একজন হতে হবে। তবে পূর্বের অনানুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান মতে এই ক্ষুদ্র শতাংশে নিশ্চিত স্থান পেতে ২০০ নম্বরে কাটাকুটি করে ১২০ নম্বর থাকলেই চলবে, এটা অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের কাছে আগেই জেনেছিলাম। অর্থাৎ ঠান্ডা মাথায় ৪০% ছেড়ে গেলেও প্রিলির দরিয়া পেরিয়ে যাওয়া যায় ইনশা আল্লাহ।
পরীক্ষা যা দিয়েছিলাম, তাতে আলহামদুলিল্লাহ তাৎক্ষণিকভাবে উপলব্ধি হয়েছে যে আল্লাহ ভরসা লিখিত পরীক্ষাও দিতে পারব। হল থেকে বেরিয়ে দেখলাম, বিভিন্ন জন দ্বৈত বা দলগতভাবে গল্প করতে করতে বের হচ্ছেন। তাঁরা হয়তো একে অপরের বন্ধু, ভাই, বোন অথবা চেনা কেউ। আর আমি ছিলাম নিশ্চুপ, একেবারেই একা।
পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে ফাস্ট ফুডের দোকানে বার্গার খেলাম। কুড়িল এসে ২০১৮ সালের জানুয়ারির একটা কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স কিনলাম। আড়াইহাজারে পৌঁছে কাচ্চি বিরিয়ানি খেলাম। বাড়ি গিয়ে সারা বিকেল-সন্ধ্যা ঘরে-বাইরে আড্ডা দিলাম আর ফাঁকে ফাঁকে ফেসবুকভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপ-পেজে প্রশ্নের বিশ্লেষণ ও সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য মেশানো উত্তর দেখলাম। দুই বেলা বাইরে খেয়ে খাবারের প্রতি ঈষৎ বীতশ্রদ্ধ আমি মায়ের হাতে রান্না করা সুখাদ্যে রসনা তৃপ্ত করে ঘরোয়া আলাপকর্ম শেষে ঘুমিয়ে পড়লাম।
*লেখক: মো. রুহুল আমিন শরিফ, প্রশাসন ক্যাডার (১ম স্থান), ৩৮ তম বিসিএস