বিসিএসে প্রাথমিক সুপারিশের পরের ধাপ এবং প্রার্থীদের করণীয়
সম্প্রতি ৪১তম বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারে মোট ২ হাজার ৫২০ প্রার্থীকে সাময়িকভাবে সুপারিশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। সুপারিশের পর থেকে যোগদান পর্যন্ত প্রক্রিয়াগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানাচ্ছেন বিসিএস কর্মকর্তা রবিউল আলম লুইপা
বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের মাধ্যমে মেধাক্রম অনুযায়ী প্রার্থীদের বিভিন্ন ক্যাডারে সাময়িক সুপারিশ করা হয়। সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) সুপারিশপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মেধাতালিকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে হস্তান্তর করে।
পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ভেরিফিকেশন ও অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিয়োগ গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়। সর্বশেষ ৪০তম বিসিএসে চূড়ান্ত ফলের (প্রাথমিক সুপারিশ) পর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুলিশ ভেরিফিকেশন–প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে গেজেট প্রকাশ করতে সাত মাসের মতো সময় লেগেছে।
স্বাস্থ্য পরীক্ষা
সাধারণত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ড সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে। আগে দেখা গেছে, সুপারিশপ্রাপ্ত সব ক্যাডারের প্রার্থীদের কয়েকটি হাসপাতালে গ্রুপ করে দেওয়া হয়েছে এবং নির্ধারিত তারিখে হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের সামনে উপস্থিত থাকতে হয়েছে। মেডিকেল বোর্ডে উপস্থিতির আগে বুকের এক্স-রে, চোখ পরীক্ষার প্রতিবেদন, ডোপ টেস্ট রিপোর্ট, রক্ত পরীক্ষা (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) সংগ্রহ করে রাখতে হয়।
এ ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠান (যেমন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) থেকে বুকের এক্স-রে এবং জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট থেকে চোখের পরীক্ষা করানো উচিত, এতে প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা বেশি থাকে। মেডিকেল বোর্ডে সাধারণত প্রার্থীদের বুকের এক্স-রে ও চোখের পরীক্ষার প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয় এবং স্বাস্থ্যগত বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা হতে পারে।
চোখের পরীক্ষার জন্য অনেক সময় দূরের দেয়ালে বিভিন্ন সাইজের বর্ণ ও সংখ্যা দিয়ে চোখের দৃষ্টি পরীক্ষা করা হতে পারে। অতিরিক্ত পরীক্ষা হিসেবে স্বাস্থ্য পরীক্ষার দিনে ইউরিন টেস্ট যুক্ত হতে পারে। ৪০তম বিসিএসে প্রাথমিক সুপারিশের চার থেকে পাঁচ মাস পর স্বাস্থ্য পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগ বিধিমালা-১৯৮১–এর বিধি-৪–এর ৩(ক) অনুসারে, ‘নিয়োগের জন্য বাছাইকৃত প্রার্থীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার মেডিকেল বোর্ডে স্বাস্থ্যগত অযোগ্যতা বা দৈহিক বৈকল্য দেখা দিলে সমাধান না হওয়া পর্যন্ত প্রার্থীকে চাকরিতে নিয়োগ করা যাবে না’।
ভেরিফিকেশন
সাধারণত মৌখিক পরীক্ষার সময় দেওয়া প্রার্থীর পুলিশ ভেরিফিকেশন ফরমের তথ্য অনুযায়ী একজন সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থীর যাবতীয় তথ্য, ঠিকানা ও ব্যক্তিগত তথ্য মিল আছে কি না, যাচাই করা হয়। সরকার নির্ধারিত সংস্থা (যেমন আইনশৃঙ্খলা সংস্থা, গোয়েন্দা সংস্থা, জেলা প্রশাসন ইত্যাদি) দিয়ে ভেরিফিকেশন–প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হতে পারে। ভেরিফিকেশনের সময় প্রার্থীকে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসহ দেখা করতে বলা হতে পারে বা প্রার্থীকে না জানিয়েও ভেরিফিকেশন হয়ে যেতে পারে।
তাই ভেরিফিকেশনের আগেই প্রার্থীকে সব একাডেমিক সার্টিফিকেট, একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র, নাগরিকত্ব সনদ, জন্মসনদ, নিজের/বাবা/মায়ের নামে থাকা জমির দলিল, বিসিএসের প্রবেশপত্র ও অ্যাপ্লিকেন্টস কপি, বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল (প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠা এবং যে পৃষ্ঠায় আপনার নিবন্ধন নম্বর আছে, সেই পৃষ্ঠা) এবং ভেরিফিকেশনকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক চাওয়া অন্য কোনো ডকুমেন্ট প্রস্তুত রাখা প্রয়োজন।
৪০তম বিসিএসের সুপারিশের আনুমানিক দুই মাস পর ভেরিফিকেশন–প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগ বিধিমালা-১৯৮১–এর বিধি-৪–এর ৩(খ) অনুসারে, ‘প্রার্থীর ভেরিফিকেশনে বা তদন্তে চাকরিতে যোগ দেওয়ার অযোগ্য বিবেচিত হলে তাঁর সুষ্ঠু উপযুক্ততা না হওয়া পর্যন্ত প্রার্থীকে চাকরিতে নিয়োগ করা যাবে না’।
৩৪তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন শামীম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভেরিফিকেশনের জটিলতা এড়াতে আপনার বিরুদ্ধে আগে থেকে কোনো আইনি প্রক্রিয়া চলমান থাকে, সেটি দ্রুত নিষ্পত্তি করে নিন। কেউ ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা তথ্য দিতে পারে, এমন মনে হলে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সে বিষয়ে অবহিত করুন। সঠিক তথ্য–প্রমাণাদি উপস্থাপন ও আপনার উপযুক্ততা প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন।
আপনি কোনো সরকারি চাকরিতে কর্মরত থাকলে আপনার অফিসেও ভেরিফিকেশন হতে পারে। ভেরিফিকেশনে বাদ পড়া মানে এই নয় যে তিনি চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে বাদ পড়ে গেলেন। আপনি যদি সত্যিই চাকরির জন্য উপযুক্ত হন এবং ভুলক্রমে বাদ পড়ে থাকেন, তাহলে পুনরায় ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে অবশ্যই চাকরিতে যোগদানের সুযোগ পাবেন।’
গেজেট
রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত বা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে স্বাক্ষরিত সরকারি ঘোষণাগুলোকে (যেমন গেজেটেড চাকরির নিয়োগ/পদোন্নতি/বদলি, নতুন জেলা/বিভাগ সৃষ্টি, কোন দিনকে সরকারি ছুটি ঘোষণা ইত্যাদির প্রজ্ঞাপন) গেজেট বলা হয়।
সরকারি প্রজ্ঞাপনগুলো বাংলাদেশ ফরম ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে পাঠানো হলে সেগুলো বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট প্রেস (বিজি প্রেস) গেজেট আকারে ছাপানোর ব্যবস্থা করে।
স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ভেরিফিকেশনের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নবনিয়োগ শাখা কর্মকর্তাদের নিয়োগপত্র গেজেট আকারে প্রকাশ করে থাকে। এই গেজেটে নিয়োগপ্রাপ্ত ক্যাডার কর্মকর্তাদের যোগদানের তারিখ, যোগদানের সময় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও বেতন-ভাতা উল্লেখ থাকে।
যোগদান
গেজেটে উল্লেখিত তারিখে সংশ্লিষ্ট ক্যাডার নিয়ন্ত্রণাকারী মন্ত্রণালয়/বিভাগ/অধিদপ্তর কর্তৃক নির্দেশিত/পদায়িত কার্যালয়ে প্রত্যেক কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসহ যোগদান সম্পন্ন করতে হয়। যেমন পুলিশ ক্যাডার ও আনসার ক্যাডার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে, কৃষি ক্যাডার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে, স্বাস্থ্য ক্যাডার ও শিক্ষা ক্যাডার অধিদপ্তর নির্ধারিত কর্মস্থলে যোগদান করে থাকেন। কোনো কর্মকর্তা নির্ধারিত তারিখে যোগদান না করলে তিনি যোগদান করতে সম্মত নন বলে ধরে নেওয়া হয় এবং তার নিয়োগ বাতিল করা হয়।
নন-ক্যাডার সুপারিশ
যাঁরা বিসিএসের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, কিন্তু পদস্বল্পতায় ক্যাডারে সুপারিশ করা সম্ভব হয় না, তাঁদের নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ (বিশেষ) বিধিমালা ২০১০ ও সংশোধিত বিধিমালা ২০১৪ অনুসারে শূন্য পদ সাপেক্ষে মেধা ও নিয়োগ বিধিমালা অনুসরণ করে প্রথম (৯ম গ্রেড) ও দ্বিতীয় শ্রেণির (১০ম, ১১তম ও ১২তম গ্রেড) বিভিন্ন নন–ক্যাডার চাকরিতে সুপারিশের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এখন পর্যন্ত ক্যাডারে সুপারিশের পর নন-ক্যাডারে সুপারিশ করা হলেও ৪৫তম বিসিএস থেকে ক্যাডার ও নন-ক্যাডারে একই সঙ্গে সুপারিশ করা হতে পারে। নন–ক্যাডারে সুপারিশকৃত প্রার্থীদেরও স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ভেরিফিকেশন–প্রক্রিয়ার পর গেজেট ও পোস্টিং অর্ডার করা হয়।