বিসিএসের কোন ধাপে পাস করা কঠিন
সরকারি কর্ম কমিশনের তথ্যমতে, ৪৬তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০৮ জন। প্রতি বিসিএসেই তিন থেকে চার লাখ প্রার্থী আবেদন করে থাকেন। তিনটি ধাপে যোগ্য প্রার্থী বাছাই করা হয়। ধাপগুলো হলো প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা। তিনটি ধাপের মধ্যে প্রিলিমিনারিতে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী বাদ পড়েন। বিসিএস পরীক্ষায় যাঁরা অংশগ্রহণ করেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ প্রার্থীর প্রায় একই ধরনের প্রস্তুতি থাকেন। যে কয়েক হাজার প্রার্থী নিজস্ব কৌশল অবলম্বন করে পড়াশোনা করেন, তাঁরাই এগিয়ে থাকেন। বিসিএসের তিনটি ধাপের মধ্যে কোন বিষয়ে পাস করা কঠিন, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ৪১তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত মো. রিয়াজ উদ্দিন।
প্রিলিমিনারি
বিসিএসের সর্বপ্রথম ধাপ প্রিলিমিনারি। প্রিলিমিনারি হচ্ছে প্রার্থীদের ছাঁটাই করার প্রক্রিয়া। বর্তমানে বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হওয়া অনেক কঠিন। ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারিতে পিএসসি কাটমার্ক নির্ধারণ করে পদসংখ্যা অনুযায়ী। একসময় ১০০ নম্বরের কম পেয়েও প্রিলিতে উত্তীর্ণ হওয়া যেত। পরবর্তীতে ৪৩তম বিসিএসে সম্ভাব্য কাটমার্ক ছিল ১১০, ৪৪তমতে ১২২ এবং সর্বশেষ ৪৫তমতে ১১৫ ছিল বলে ধরে নেওয়া হয়। কাটমার্কের এই ঊর্ধ্বগতি বিসিএসের প্রতি চাকরি প্রার্থীদের আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়া এবং অতিরিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাকেই নির্দেশ করে। যেহেতু একটি বিসিএসের নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হতেই তিন-চার বছর লেগে যায়, তাই প্রার্থীরা প্রথমবারেই পাস করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। সর্বশেষ ৪১ ও ৪৩তম বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্তদের বেশিরভাগই প্রথম বিসিএসেই ক্যাডার হয়েছেন। এখন যাঁরা বিসিএসকে টার্গেট করেন, তাঁরা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা এবং একাগ্রতা নিয়েই বিসিএস যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে থাকেন। তাই আগের মতো ভাসাভাসা প্রস্তুতি নিয়ে এখন প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হওয়া অসম্ভব।
বিসিএসের সবচেয়ে কঠিন ধাপ হলো প্রিলিমিনারি। দুই ঘণ্টার এই পরীক্ষায় মাথা ঠান্ডা রেখে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে যাঁরা বৃত্ত ভরাট করবেন, কেবল তাঁরাই বিজয়ী হবেন। প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনেকটা টি–টোয়েন্টি খেলার মতো। তাই খুব ভালো প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও স্নায়ু চাপ কিংবা অন্য যে কোনো কারণে আপনার খারাপ সময় যেতেই পারে। খেলার মাঠে যেমন কৌশল, দক্ষতা, একাগ্রতা এবং সর্বোচ্চ পরিশ্রম দিয়ে জিততে হয়, প্রিলিমিনারির এই দুই ঘণ্টা সময়কে যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে আপনিও স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপে কৃতকার্য হতে পারেন। ৪১তম বিসিএসে আবেদনকারী ছিল ৪ লাখ ৭৫ হাজার প্রার্থী। প্রিলিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন মাত্র ২১ হাজার ৫৬ জন। পাসের হার ৪.৪৩ শতাংশ। ৪০তম বিসিএসে ৪ লাখ ১২ হাজার প্রার্থী আবেদন করেছিলেন। প্রিলিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন মাত্র ২০ হাজার ২৭৭ জন। পাসের হার ৪.৯২ শতাংশ। সর্বশেষ ৪৫তম বিসিএস প্রিলিমিনারিতে মাত্র ১২ হাজার ৭৯২ জন প্রার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন। এই বিসিএসে আবেদনকারী ছিল ৩ লাখ ১৮ হাজার প্রার্থী। প্রিলিমিনারি উত্তীর্ণের হার ৪.০২ শতাংশ। বর্তমানে পিএসসি এক বছরে এক বিসিএস শেষ করার কার্যক্রম হাতে নেওয়ায় প্রিলিতে আরও কম প্রার্থী পাস করানো হচ্ছে।
দুই ঘণ্টার এই পরীক্ষায় প্রার্থীদের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ নেতিবাচক নম্বর থাকা। প্রতি ভুল উত্তরের জন্য .৫০ নম্বর কাটা হয়। তাই সংশয়পূর্ণ প্রশ্ন যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়াই উত্তম। এ জন্য প্রয়োজন বিষয়ভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি। প্রস্তুতি যত ধারালো হবে সংশয় তত কমে আসবে এবং পরীক্ষাকেন্দ্রে আপনার আত্মবিশ্বাস ততই বেড়ে যাবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যাওয়া এবং কমসংখ্যক প্রার্থী টেকানোর কারণে ভবিষ্যতে বিসিএস প্রিলিমিনারি উত্তীর্ণ হওয়া দুর্গম পাহাড় অতিক্রম করার মতো কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে।
লিখিত
বিসিএসের অপেক্ষাকৃত সহজ ধাপ হচ্ছে লিখিত। প্রিলিতে পিএসসি প্রার্থীদেরকে পাস করায় আর লিখিত পরীক্ষায় প্রার্থীরা নিজেরা পাস করে। প্রিলিতে উত্তীর্ণ হওয়া যতটা কঠিন, লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া ততটাই সহজ। ৯০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষায় পঞ্চাশ শতাংশ নম্বর পেলেই পাস করা যায়। লিখিত সিলেবাসের প্রায় অর্ধেক প্রিলির সঙ্গে মিল আছে। একজন প্রার্থী প্রিলিতে উত্তীর্ণ হওয়া মানেই তাঁর লিখিত প্রস্তুতির অর্ধেক ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে ধরা হয়। ৪৩তম বিসিএসে প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ ১৫ হাজার ২২৯ জনের মধ্যে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন ৯ হাজার ৮৪১ জন। পাসের হার ৬৪.৬২ শতাংশ।
৪১তম বিসিএসে প্রিলিতে উত্তীর্ণ ২১ হাজার ৫৬ জনের মধ্যে ১৩ হাজার প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। পাসের হার ৬১.৭৪ শতাংশ। ৪০তম বিসিএসে লিখিত পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৫৪ শতাংশ। লিখিত পরীক্ষায় যাঁরা কোনো রকম প্রস্ততি ছাড়াই পরীক্ষা দেন কিংবা অসুস্থতা, ব্যস্ততা বা অন্য কোনো কারণে কেবল নামমাত্র অংশগ্রহণ করে থাকেন, তাঁরাই ফেল করেন। ফ্রি হ্যান্ড রাইটিং, উপস্থাপনা, খাতা সাজানো এবং পরীক্ষাকেন্দ্রে সময় ব্যবস্থাপনা ভালো হলে লিখিত পরীক্ষা সহজেই উতরে যাওয়া যায়। তবে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া আর ক্যাডার পাওয়া এক কথা নয়। ক্যাডার পাওয়ার জন্য লিখিত পরীক্ষা খুব ভালো হওয়া আবশ্যক। লিখিতকে বলা হয় বিসিএসের প্রাণ। খুব ভালো লিখিত পরীক্ষা দিয়ে মৌখিক পরীক্ষা গড়পড়তা মানের হলেও একটি ক্যাডার পাওয়ার প্রত্যাশা করা যায়। লিখিততে ৬০-৬৫ শতাংশ নম্বর পেলেই আপনি যেকোনো একটি ক্যাডার পেতে পারেন । যাঁরা গণিত ও বিজ্ঞানে ভালো দক্ষতা রাখেন, তাঁরা লিখিততে অনেকটা এগিয়ে থাকেন।
মৌখিক
বিসিএস মৌখিক পরীক্ষায় ২০০ নম্বর বরাদ্দ থাকে। ৫০ শতাংশ নম্বর পেলেই পাস করা যায়। মৌখিক পরীক্ষায় কোনো প্রশ্নের উত্তর না পারলেও সাধারণত ফেল করানো হয় না, যদি না আপনি বোর্ডে কোনো অসৌজন্যমূলক আচরণ করে থাকেন। মৌখিক পরীক্ষায় এমন অনেক কিছু জিজ্ঞেস করা হয়, যা আপনি সাধারণ বোধোদয় থেকেও উত্তর করতে পারবেন। মৌখিক পরীক্ষাকে খুব সহজ এবং উপভোগ্য করতে পারলে ভালো নম্বর পাওয়া কঠিন কিছু নয়। বর্তমানে মৌখিকে খুবই কম প্রার্থীকে ফেল করানো হয়। ৪১তম বিসিএসে ১৩ হাজার লিখিত উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে ২ হাজার ৫২০ জন ক্যাডার পেয়েছেন এবং ৯ হাজার ৮২১ জন নন-ক্যাডারের জন্য মনোনিত হয়েছেন। শুধু ৬৫৯ জন অনুত্তীর্ণ হয়েছেন। মৌখিকে উত্তীর্ণ হওয়ার হার প্রায় ৯৪ শতাংশ। যদিও অনুত্তীর্ণদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যাঁরা ভাইভায় উপস্থিত হননি। ৪০তম বিসিএস মৌখিকেও কেবল ৮৩৫ জন অনুত্তীর্ণ হয়েছেন। মৌখিকে উত্তীর্ণ হওয়ার হার ছিল ৯২.৩৮ শতাংশ।
বিসিএসে লিখিত ও মৌখিকের তুলনায় প্রিলিমিনারি অনেক কঠিন ধাপ। এমসিকিউ–ভিত্তিক পরীক্ষা হওয়ায় প্রিলিতে অনুমাননির্ভর উত্তর করার কোনো সুযোগ নেই। বরং তা হিতে বিপরীত হতে পারে। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীরাও প্রিলিমিনারির বাধা টপকাতে পারেন না। প্রিলিমিনিরি পরীক্ষা অনেকেরই বিসিএস ক্যাডার হওয়ার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে। অপর দিকে লিখিত পরীক্ষায় কোনো বিষয়ে কিছু ধারণা থাকলেও আপনি মোটামুটি লিখতে পারবেন। মৌখিকেও অনেক সাধারণ প্রশ্ন করা হয় আপনাকে যাচাই করার জন্য, যেগুলো খুব বেশি প্রস্তুতি ছাড়াই সহজে উত্তর করা যায়। তাই বিসিএস প্রিলিমিনারি পাসের জন্য আপনার প্রস্তুতিতে কোনো রকম ঘাটতি রাখার সুযোগ নেই। অনেকেই প্রিলি পাসের আগেই লিখিত প্রস্তুতি নিয়ে চিন্তিত থাকেন, যা একেবারই কাম্য নয়। বিশেষ করে যাঁরা প্রথমবার প্রিলি দেবেন, তাঁদের জন্য প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হওয়া তুলনামূলক কঠিন। অভিজ্ঞ প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আপনাকে প্রিলির জন্য শতভাগ প্রস্তুত হতে হবে। প্রিলির আগে লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে প্রিলির প্রস্তুতিতে যেন কোনোভাবেই ব্যাঘাত না ঘটে, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। তাই যাঁরা বিসিএসকেন্দ্রিক প্রস্তুতি নেবেন, আপনার প্রথম এবং প্রধান টার্গেট হওয়া উচিত প্রিলিমিনারি উত্তীর্ণ হওয়া এবং সে জন্য নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। আপনার হাতে প্রচুর সময় থাকলে গণিত, বিজ্ঞান ও ইংরেজির মৌলিক বিষয়গুলো চর্চা করে লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্যও এগিয়ে থাকতে পারেন।