৪৬তম বিসিএস লিখিত: আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির প্রস্তুতিতে করণীয়
৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতির বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন ৪১তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়া ও ৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে প্রথম স্থান অধিকারী শানিরুল ইসলাম শাওন। আজ পঞ্চম পর্বে আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির প্রস্তুতির পরামর্শ ছাপা হলো—
আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিতে তিন ঘণ্টায় ১০০ নম্বরের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। মানসিক দক্ষতা ও ইংরেজির পর এ বিষয়ের পরীক্ষায় তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে বেশি সময় পাওয়া যায় উত্তর করার জন্য। তাই এ বিষয়ে পরীক্ষককে একটি পরিচ্ছন্ন পরীক্ষা উপহার দেওয়া সম্ভব।
এ বিষয়ের পরীক্ষায় মোট তিনটি অংশে ৪ নম্বর করে মোট ১০টি জ্ঞানমূলক প্রশ্ন, ১৫ নম্বর করে তিনটি বর্ণনামূলক প্রশ্ন এবং ১৫ নম্বরের একটি সমস্যা সমাধানমূলক প্রশ্ন থাকে। আগে বিকল্প থাকলেও গত তিন-চারটি বিসিএস পরীক্ষায় কোনো অংশেই বিকল্প কোনো প্রশ্ন থাকেনি। তাই সব প্রশ্নের উত্তর করতে হয়। মূলত এ কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে পরীক্ষা কঠিন মনে হয়।
১৮০ মিনিটের এই পরীক্ষায় ৮ মিনিট বিয়োগ করে ১৭২ মিনিট সময় ধরে যদি পরীক্ষার কৌশল সাজানো যায়, তবে ৪ নম্বরের প্রশ্নের উত্তরের জন্য মোটামুটি ৭ মিনিট এবং ১৫ নম্বরের প্রশ্নের উত্তরের জন্য ২৫ দশমিক ৫ মিনিট সময় পাওয়া যায়। আপনি এ সময়ের মধ্যে যতটুকু লিখতে পারেন, উত্তরের কলেবর ততটুকুই হবে। বক্তার ভাব প্রকাশের জন্য এ সময় পর্যাপ্ত।
বিগত ৩৫তম থেকে ৪৫তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন থেকে অধ্যায়ভিত্তিক গুরুত্ব খোঁজা যাক। আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির পরিচিতিতে প্রশ্ন এসেছিল ৩টি, বিশ্বের বিভিন্ন কর্মক থেকে ২২টি, ক্ষমতা ও নিরাপত্তায় ২৩টি, প্রধান ধারণা ও মতবাদে ৯টি, বৈদেশিক নীতি ও কূটনীতিতে ৯টি, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্কে ১৫টি ও বৈশ্বিক পরিবেশে ৪টি প্রশ্ন এসেছিল।
ওপরের বিশ্লেষণ থেকে যে পাঁচটি অধ্যায়ে বেশি প্রশ্ন এসেছিল, সেগুলো থেকে বিগত প্রশ্নসহ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পড়ে নিতে হবে। আর বেশি প্রশ্ন কমন পাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির পরিচিতি ও বৈশ্বিক পরিবেশ অধ্যায় পড়ে নেওয়া ভালো। কারণ, বৈশ্বিক পরিবেশ থেকে প্রশ্ন আসার সম্ভাবনা বেশি।
বর্ণনামূলক প্রশ্নে জাতিসংঘ বিষয় থেকে প্রশ্ন এসেছিল ৮টি, প্রধান শক্তিগুলোর মধ্যে বৈদেশিক সম্পর্ক থেকে প্রশ্ন এসেছিল ৫টি, বৈশ্বিক উদ্যোগ ও প্রতিষ্ঠানে ৬টি, আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৪টি, বিশ্বের প্রধান সমস্যা ও দ্বন্দ্ব বিভাগ থেকে ১৩টি প্রশ্ন এসেছিল, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি বিষয় থেকে ১৭টি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ বিষয় থেকে ৬টি প্রশ্ন এসেছিল।
আমার ধারণা, এবারের পরীক্ষায় জাতিসংঘ বিষয়, প্রধান শক্তিগুলোর মধ্যে বৈদেশিক সম্পর্ক, বিশ্বের প্রধান সমস্যা ও দ্বন্দ্ব এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি অধ্যায় থেকে প্রশ্ন আসার সম্ভাবনা বেশি।
প্রস্তুতির জন্য যা করতে হবে
নিয়মিত দৈনিক পত্রিকা না পড়ে আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির পরীক্ষা দিতে বসাটা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই নিয়মিত পত্রিকার আন্তর্জাতিক, সম্পাদকীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক ও দেশীয় তথ্য পাতায় চোখ বোলানো জরুরি। একজন কলাম লেখক একটা বিষয়ে বেশ গবেষণা এবং পড়াশোনা করেই একটা কলাম লেখেন এবং তা দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হয়। তাই চলমান গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির ওপর একাধিক সম্পাদকীয় বা কলাম পড়ার মাধ্যমে তথ্যগুলো (পটভূমি, ডেটা, উক্তি) বেশ সমৃদ্ধ হয়। এ ক্ষেত্রে উত্তর লেখার সময় স্বতন্ত্র উত্তর তৈরি হয়। বর্ণনামূলক প্রশ্নগুলোর ভালো উত্তর করার জন্য বইয়ের পাশাপাশি পত্রিকার কোনো বিকল্প নেই।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্নগুলোর জন্য প্রতিটি অধ্যায় থেকে সংজ্ঞার পাশাপাশি উদাহরণ ও মনীষীদের উক্তি ও প্রামাণ্য সংজ্ঞা জানতে হবে। বিভিন্ন মতবাদ, কূটনীতি, সংগঠনের সদস্য, সম্মেলন, প্রতিবেদনের ধারা ইত্যাদি বেশ ভালোভাবে মুখস্থ করে ফেলতে হবে।
৪ নম্বরের প্রশ্নের উত্তরে প্রথমে সাধারণ ভাষায় সংজ্ঞা, প্রামাণ্য সংজ্ঞা বা মনীষীদের উক্তি, এক বা একাধিক উদাহরণ, সম্ভব হলে ছোট চিত্র—এভাবে লেখার ক্রম অনুসরণ করা যায়। অবশ্যই প্যারা আকারে লিখবেন। প্রশ্নে কোনো কিছুর বৈশিষ্ট্য জানতে চাইলে বড় বড় বাক্য হলে কমপক্ষে চারটি এবং ছোট ছোট বাক্য হলে কমপক্ষে সাতটি বৈশিষ্ট্য লেখা উচিত। পার্থক্য জানতে চাইলে টেবিল আকারে কমপক্ষে চারটি পার্থক্য উদাহরণসহ দেওয়া উচিত।
বাংলা মাধ্যমে পরীক্ষা দিলেও প্রশ্নের উত্তরে প্রামাণ্য সংজ্ঞা বা মনীষীদের উক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে ইংরেজিতে দেওয়া যেতে পারে। এতে নম্বর ভালো ওঠে। পার্থক্যের টেবিল, চিত্র বা ডায়াগ্রাম পেনসিলে আঁকবেন। উত্তরের শিরোনাম, ডেটা বা উক্তি নীল কালিতে লিখবেন।
বর্ণনামূলক প্রশ্নের উত্তরে অবশ্যই ম্যাপ আঁকতে হবে। বাংলাদেশ ও এর প্রতিবেশীদের নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ম্যাপ, দক্ষিণ চীন সাগর অঞ্চল, আরব উপদ্বীপ ও হরমুজ প্রণালি, বিআরআই নৌপথের কানেকটিভিটি ম্যাপ, স্ট্রিং অব পার্লস (মুক্তার মালা থিওরি) ম্যাপ, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের ম্যাপ, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ম্যাপ, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল এবং রাশিয়া-ইউক্রেন অঞ্চলের ম্যাপ—এসব ম্যাপ অঙ্কনের চর্চা করতে হবে। পড়ার টেবিলের সামনে বিশ্ব মানচিত্র যেন টাঙানো থাকে এবং তাতে নিয়মিত চোখ বোলানো যেন নিশ্চিত করা হয়।
বর্ণনামূলক প্রশ্নের উত্তরে ভূমিকা, সংজ্ঞা, পটভূমি, সাম্প্রতিক ঘটনা, ফলাফল, কী হতে পারে, কী করণীয়, উপসংহার—এভাবে ভাগ করে করে প্যারা আকারে লিখবেন। উত্তর কতটুকু দীর্ঘ হবে—এর উত্তর হলো ২৫ দশমিক ৫ মিনিট সময়ে যতটুকু দীর্ঘ লেখা যায়।
সমস্যা সমাধানমূলক প্রশ্নের উত্তর করার ক্ষেত্রে এবার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় হতে পারে—ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত ও বাংলাদেশের সমর্থন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত অস্থিরতা ও টেকসই সমাধানে করণীয়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যকরে বাংলাদেশের করণীয়, ন্যাটো সম্প্রসারণ ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায় করণীয় ইত্যাদি।
সমস্যা সমাধানের প্রশ্নের উত্তরে পরীক্ষার্থীরা উত্তরের ফরম্যাট নিয়ে বেশ চিন্তায় থাকেন। আমার মতে, ফরম্যাট নিয়ে না ভেবে এ ক্ষেত্রে লেখার মান ও উপাদান নিয়ে জোর দেওয়া উচিত। প্রশ্নে আপনাকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উল্লেখ করলে আপনার সুপারিশগুলো সেভাবে চিন্তা করেই লেখার চেষ্টা করা উচিত। ফরম্যাট অনুসরণ করতে গেলে তা যৌক্তিক তো হয়ই না, বরং ভুল হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। উত্তরে শিরোনাম, ভূমিকা, পটভূমি, প্রামাণ্য সংজ্ঞা, উক্তি, রেফারেন্স, সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ, করণীয়, সম্ভাবনা, উপসংহার—এই ক্রম অনুসরণ করে লেখা যেতে পারে। উত্তরে ডেটা বা তথ্য দিলে সেটির উৎস দেবেন, সেটা কোনো প্রতিবেদন, সমীক্ষা বা দৈনিক পত্রিকা যা-ই হোক।