কর্মী ছাঁটাই অর্থনীতিতে যে প্রভাব ফেলতে পারে
আমেরিকায় সবচেয়ে বড় ও ধনী প্রতিষ্ঠানগুলো সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বিপুলসংখ্যক কর্মী ছাঁটাই করেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। চলতি সপ্তাহে প্রযুক্তি জায়ান্ট অ্যামাজন ব্যয় কমাতে ১৮ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে, যা প্রতিষ্ঠানটির মোট কর্মীর ৬ শতাংশ। আর বিজনেস সফটওয়্যার কোম্পানি সেলসফোর্স ঘোষণা দিয়েছে, তারা ১০ শতাংশ বা প্রায় ৮ হাজার কর্মী ছাঁটাই করবে।
এর আগে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রামের প্রতিষ্ঠান মেটা, হার্ডওয়্যার কোম্পানি সিসকো, পেমেন্টপ্রতিষ্ঠান স্ট্রাইপসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান বিপুলসংখ্যক কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে।
এমন পরস্থিতিতে বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে কর্মী ছাঁটাইয়ের ফলে মন্দার মধ্যে অর্থনীতিতে কোনো প্রভাব পড়ে কি না বা অর্থনৈতিক সংকটের যে পূর্বাভাস আছে, তা বাস্তবে রূপ পাওয়ার ঝুঁকি থাকে কি না—তা খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।
আমেরিকার সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরের মধ্যে দেশটিতে ২ লাখ ২৩ হাজার নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির এই গতি ২০২১ সালের তুলনায় অনেক ধীর। করোনা মহামারি থেকে বেরিয়ে যখন অর্থনীতির চাকা সচল হতে শুরু করে, তখন কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে গতি ছিল, ২০২২ সালে সেই গতি ধীর পরিলক্ষিত হয়েছে। দেশটিতে এখন বেকারত্বের হার রেকর্ড পরিমাণ অর্থাৎ ৩ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
সতর্কসংকেত
দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান দাম ভোক্তাদের ওপর ব্যাপক প্রভাব রাখায় আগামী অর্থনীতি অনেক ধীরগতির হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে।
মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছর সুদের হার বাড়ানোর কারণে কোম্পানিগুলো ঋণের খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। এ কারণে প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলো কর্মী ছাঁটাই করে ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছে। এটা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সতর্কসংকেত কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
আমেরিকার চাকরিসংক্রান্ত ওয়েবসাইট জিপরিক্রুটারের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জুলিয়া পোলাক বলেন, ‘আমার মনে হয় না, এসব নিয়ে মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে। আমরা এখন যা দেখছি, এটা একটা সংশোধন হতে পারে। কোনো অর্থনৈতিক মন্দার শুরু এটা নয়।’
কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণার জন্য করোনা মহামারি চলাকালীন অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগকে দায়ী করছে প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষ বলছে, মহামারি চলাকালীন অধিকাংশ কাজ অনলাইনে শুরু হওয়ায় ব্যবসায় বেশ উন্নতি হয়েছিল।
গত বছর উচ্চ সুদের হার ও মার্কিন শেয়ারবাজারে তীব্র মন্দার কারণে ছোট স্টার্টআপগুলোর তহবিল শেষ হয়ে গেছে। ক্রিপ্টো সেক্টরও এ ব্যাপারে কোনো সহযোগিতা করতে পারেনি।
নিরীক্ষা, কর ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আরএসএমের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জো ব্রাসেলাস বলেন, কম সুদের হারের কারণে মহামারি চলাকালীন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলো বিপুলসংখ্যক জনবল নিয়োগ করেছিল। এ কারণে এখন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলোর এই কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা ‘প্রয়োজনীয় ও প্রত্যাশিত’। এটা মূলত সমন্বয় করা।
জো ব্রাসেলাস আরও বলেন, অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ যুগের অবসান হয়েছে। প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিদের উচিত প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ সম্পর্কে নতুন প্রত্যাশার জন্য প্রস্তুত থাকা।
চলতি বছর ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যে আসন্ন মন্দা ও অর্থনীতির বড় উত্থান–পতন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর খুব বেশি প্রভাবিত করবে না বলেও জানিয়েছেন তিনি।
জো ব্রাসেলাস বলেন, কর্মী ছাঁটাইয়ের বিষয়টিকে বড় করে দেখার কিছু নেই। কারণ, চাকরি হারানো কর্মীরা অন্তত আমেরিকায় দ্রুত নতুন চাকরি খুঁজে নিতে পারছেন। প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলো মূলত বিদেশি কর্মীদের বেশি ছাঁটাই করছে।
শ্রম বিভাগের সবশেষ চাকরিসংক্রান্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে গত নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বেতন মাত্র পাঁচ হাজার কমেছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় হাজারো কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা এলেও এক বছর আগের তুলনায় কর্মসংস্থান বেড়েছে।
তবে গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্তালিনা জর্জিয়েভা সতর্ক করে বলেছেন, চলতি বছর বিশ্বের এক–তৃতীয়াংশ অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে পড়তে পারে। এতে যেসব প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান বিদেশে বড় ব্যবসা পরিচালনা করে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বর্তমানে আমেরিকার শ্রমবাজার অপ্রত্যাশিতভাবে স্থিতিশীল আছে। এ কারণে অনেকেই আশাবাদী যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার ও দ্রব্যমূল্যে বৃদ্ধির পরও দেশটি কঠিন অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।
বার, রেস্তোরাঁ, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান, নির্মাণ ব্যবসাসহ মার্কিন অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি খাতে গত মাসে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়েছে।
প্রযুক্তি, আবাসন ও ব্যাংক খাতে কর্মী ছাঁটাইয়ের সংখ্যা বাড়লেও গত বছর এই হার রেকর্ড পরিমাণ নিচে নেমে এসেছিল বলে জানিয়েছেন চাকরিসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান চ্যালেঞ্জার, গ্রে অ্যান্ড ক্রিসমাসের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু চ্যালেঞ্জার। তিনি বলেন, কর্মী ছাঁটাইসংক্রান্ত ঘোষণা ১৯৯০ সাল থেকে চলে আসছে।
অ্যান্ড্রু চ্যালেঞ্জার বলেন, ‘আমরা শ্রমবাজার স্থবির হতে দেখেছি। বর্তমানে এই পরিস্থিতি মূলত মন্থর। এটা আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি নয়।’
আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক জেফ্রি ফেফার বলেছেন, কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণায় তিনি বেশ উদ্বিগ্ন। কারণ, এতে তাঁর সহকর্মীরাও চাপের মুখে পড়ছেন। আর অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো এই নীতি অনুসরণ করবে। অথচ প্রতিষ্ঠানগুলো সব সময় মুনাফার মধ্যেই থাকে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে অর্থনৈতিক সংকটের যে পূর্বাভাস আছে, তা বাস্তব রূপ পাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
জেফ্রি ফেফার বলেন, ‘কোনো একটি প্রতিষ্ঠান যা করে, অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো পরে একই কাজ করে। সব প্রতিষ্ঠান যদি কর্মী ছাঁটাই করে, তাহলে বেকারত্বের হার অনেক বেড়ে যাবে এবং প্রকৃতপক্ষে আমাদের অর্থনীতির অবস্থা আরও খারাপ হবে।’